নির্জন সড়ক। সড়কের পাশে লেক। লেক থেকে উদ্ধার হয় অর্ধগলিত একটি লাশ। লাশ কার, লাশটি লেকে কীভাবে এল, কে বা কারা তাঁকে হত্যা করল, হত্যার কারণই-বা কী—এসব বিষয়ে পুলিশের কোনো ধারণা নেই। এমন একটি সূত্রহীন হত্যার রহস্য অনেকটা কাকতালীয়ভাবে উদ্ঘাটনের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাটি নিয়ে আমরা অনেকটা অন্ধকারে ছিলাম। অন্ধকারে ঢিল ছুড়তে ছুড়তে দুয়ে-দুইয়ে চার মিলে যায়। উদ্ঘাটিত হয় হত্যার রহস্য। তবে হত্যাকাণ্ডের শিকার রিকশাচালকের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি।’
গত ১২ জুন রাজধানীর ডেমরা এলাকার মহাকাশ সড়কের পাশের লেক থেকে অজ্ঞাতপরিচয়ের ব্যক্তির লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ডেমরা থানায় একটি হত্যা মামলা করে পুলিশ। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয়ের ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। এই হত্যার বিষয়ে পুলিশ কোনো সূত্রই খুঁজে পাচ্ছিল না।
ডেমরা থানা-পুলিশ জানায়, লাশটি উদ্ধারের ২১ দিনের মাথায় গত ৩ জুলাই দিবাগত রাত দেড়টার দিকে মহাকাশ সড়কে রিকশা ছিনতাইকালে দুই ব্যক্তি আটক হন। এক ছিনতাইকারী পালিয়ে যান। ভুক্তভোগী রিকশাচালক বারবার পুলিশকে বলছিলেন, তিনি মহাকাশ সড়কে যেতে চাননি। বেশি ভাড়ার প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে তাঁকে এই সড়কে নিয়ে যান ছিনতাইকারীরা। পরে তাঁরা তাঁর রিকশাটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেন।
পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) মধুসূদন দাস প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগী এই রিকশাচালকের মুখ থেকে ‘মহাকাশ সড়ক’ শব্দ দুটি শুনে প্রায় এক মাস আগে উদ্ধার হওয়া লাশটির কথা মাথায় আসে। মহাকাশ সড়কটি ডেমরার প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত। এলাকাটিতে তেমন জনবসতি নেই। তাই এলাকাটি একেবারে নির্জন। অনেকটা আন্দাজের বশে আটক দুই ছিনতাইকারীকে অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশটির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। একপর্যায়ে তাঁরা স্বীকার করেন, ওই ব্যক্তিকে তাঁরা খুন করে তাঁর রিকশাটি ছিনতাই করেছিলেন।
ডেমরা-থানা পুলিশের তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দুই ছিনতাইকারীর স্বীকারোক্তির পরই জানা যায়, খুনের শিকার ব্যক্তি রিকশাচালক ছিলেন। গত ৮ বা ৯ জুন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ব্যাটারিচালিত ওই রিকশাচালককে নিয়ে ডেমরার মহাকাশ সড়কে যান তিন ছিনতাইকারী। এই দলে একজন নারী সদস্য ছিলেন। তিনি অসুস্থতার ভান ধরে রিকশাচালকের সহায়তা চেয়েছিলেন। এ কারণেই চালক দূরের পথের যাত্রী তাঁর রিকশায় তুলেছিলেন। দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ডেমরার মহাকাশ সড়কে পৌঁছালে চালকের গলায় গামছা পেঁচিয়ে তাঁর রিকশাটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীরা। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে লেকের একটি ব্রিজের রেলিংয়ের সঙ্গে মাথায় আঘাত করে রিকশাচালককে হত্যা করা হয়। পরে লাশটি লেকে ফেলে রিকশা নিয়ে পালিয়ে যান ছিনতাইকারীরা।
৩ জুলাই গভীর রাতে রিকশা ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়া দুই ব্যক্তি হলেন মো. ফরহাদ (২৫) ও সুমি (২৫)। ডেমরা-থানা পুলিশ বলছে, ঘটনার দিন ছিনতাইকালে রিকশাচালক চিৎকার শুরু করেন। তাঁর চিৎকার শুনে স্থানীয় কয়েকজন এগিয়ে আসেন। এ সময় ফরহাদ ও সুমি মহাকাশ সড়কের পাশের লেকে নেমে পড়েন। শাওন হাওলাদার (২২) নামের আরেক ছিনতাইকারী পালিয়ে যান। খবর পেয়ে মহাকাশ সড়কের কাছের টেংরা এলাকায় টহলরত পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। তাঁরা ফরহাদ ও সুমিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। ৬ জুলাই শাওনকে পটুয়াখালী থেকে ধরা হয়। তিনজনকেই হত্যা মামলাটিতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনজনই হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা এখন কারাগারে আছেন।
পুলিশের ডেমরা অঞ্চলের এসি মধুসূদনের ভাষ্য, ধরা পড়া তিন ব্যক্তিই পেশাদার ছিনতাইকারী। তিনজনই যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় পাশাপাশি বাসায় থাকতেন। প্রায় ছয় মাস ধরে তাঁরা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই করে আসছিলেন। তাঁরা তিনজন গভীর রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে রিকশা ভাড়া করে ডেমরার মহাকাশ সড়কে আসতেন। তারপর গলায় গামছা বা বেল্ট পেঁচিয়ে চালককে কাবু করে রিকশা ছিনতাই করতেন তাঁরা। তাঁরা মূলত ডেমরা এলাকার বাইরের রিকশাচালকদের ছিনতাইয়ের নিশানা বানাতেন। রিকশাচালককে ডেমরায় নিয়ে আসার জন্য সুমি অসুস্থতার ভান ধরতেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ফরহাদ ও শাওন আগে রিকশাচালক ছিলেন। সুমি কোনো কাজ করতেন না। কিছুদিন আগে সুমির সঙ্গে তাঁর স্বামীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। পাশাপাশি বাসায় বসবাস করার কারণে সুমির অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা জানতেন ফরহাদ ও শাওন। দলে একজন নারী সদস্য থাকলে ছিনতাইয়ের কাজটি সহজ হবে—এমন চিন্তা থেকেই তাঁরা সুমিকে সঙ্গে নেন। ফরহাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। শাওনের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে। সুমির বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনায়।
খুনের শিকার অজ্ঞাতপরিচয়ের চালকের কাছ থেকে ছিনতাই করা রিকশাটি ২২ হাজার টাকায় ছিনতাইকারীরা বিক্রি করেছিলেন বলে জানায় পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, রিকশাটি কিনেছিলেন মো. সোহেল (৩৫) নামের এক গ্যারেজের মালিক। তাঁর রিকশার গ্যারেজটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। তিনি মূলত চোরাই রিকশা কেনাবেচা করতেন। গত ৩ জুলাই তাঁকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছিনতাই হওয়া রিকশাটি তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। এ মামলায় সোহেল অবশ্য জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন।
এসি মধুসূদন বলেন, ‘রিকশা বিক্রির ২২ হাজার টাকার মধ্যে সুমি পেয়েছিলেন ৪ হাজার টাকা। ফরহাদ ও শাওন বাকি টাকা ভাগ করে নিয়েছিলেন।’
খুনের শিকার রিকশাচালকের পরিচয় এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে জানান এসি মধুসূদন। তিনি বলেন, ‘হতভাগ্য রিকশাচালকের স্বজনেরা হয়তো জানেন না, তিনি খুন হয়েছেন। স্বজনেরা হয়তো অপেক্ষায় আছেন, একদিন তিনি ফিরে আসবেন। এখন পর্যন্ত তাঁর পরিচয় জানতে না পারার একটা আক্ষেপ আমাদের থেকেই গেল।’
ডেমরা থানা-পুলিশ বলছে, খুনের শিকার অজ্ঞাতপরিচয়ের রিকশাচালকের বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির মধ্যে। তাঁর লাশ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়েছে।
এসি মধুসূদন বলেন, খুনের শিকার ব্যক্তির পরিচয় জানতে পুলিশের চেষ্টায় কোনো ত্রুটি ছিল না। বিভিন্ন থানার নিখোঁজ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন আন্তনগর বাস ও অটোরিকশার পেছনে লাশের ছবি দিয়ে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়েও পরিচয় জানার চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন রিকশার গ্যারেজে খোঁজ নিয়েও তাঁর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডেমরা থানা-পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল হাসান বলেন, ‘খুন হওয়া অজ্ঞাতপরিচয়ে রিকশাচালকের পরিচয় জানার চেষ্টা আমরা এখনো চালিয়ে যাচ্ছি।’