বাকলিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম
বাকলিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে প্রতারণা

উপবৃত্তির আবেদনের পর শিক্ষার্থীদের তথ্য বেহাত

ফাঁদে পা দিয়ে ইতিমধ্যে কলেজের চার শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ১ লাখ ৩ হাজার ৬০০ টাকা খুইয়েছেন।ফাঁদে পা দিয়ে ইতিমধ্যে কলেজের চার শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ১ লাখ ৩ হাজার ৬০০ টাকা খুইয়েছেন।

চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া সরকারি কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবককে সম্প্রতি একজন প্রতারক ফোন করেন। ওই শিক্ষার্থী সরকারি উপবৃত্তি বাবদ ১৫ হাজার টাকা পেয়েছে, এমন তথ্য জানিয়ে প্রতারক ডেবিট কার্ডের নম্বর নেন। এরপর তাঁর মুঠোফোনে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) আসে। তা-ও বলেন। পরে দেখেন নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা উধাও। হিসাবে থাকা ৩০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। টাকা যায় মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) একটি নম্বরে।

৯ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লার বাসিন্দা ওই অভিভাবককে ফোন করেন প্রতারক। কলেজের শিক্ষক পরিচয়ে ফোন করা হয়। এরপর উপবৃত্তির টাকা দেওয়ার কথা বলে ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেন প্রতারক। ওই অভিভাবক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফোন করে মেয়ের নাম ও আমার নাম প্রতারক ঠিকঠাকভাবে বলেছে। পাশাপাশি কোন শ্রেণিতে পড়ে, সেটিও বলেছে। এ ছাড়া শিক্ষকের পরিচয় দেওয়ায় কারণে বুঝতেই পারিনি যে কোনো প্রতারক ফোন করেছে।’

শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রতারকের হাতে যাওয়ার বিষয়টি ভয়ংকর। এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে প্রতারকেরা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারে।
আবু হাসনাত মোহাম্মদ আশফাক হাবীব, বিভাগীয় প্রধান, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

শুধু এ অভিভাবক নন, গত ডিসেম্বর থেকে চলতি ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাকলিয়া সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রতারক চক্রের ফোন পেয়েছেন। এই শিক্ষার্থীরা সবাই সরকারি উপবৃত্তি পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। তাদের ফোন করে বোর্ড কর্মকর্তা, কলেজের শিক্ষক কিংবা অধ্যক্ষের কার্যালয়ের কর্মচারী পরিচয় দিয়ে প্রতারক চক্র বলেছে, উপবৃত্তি নিশ্চিত করতে টাকা পাঠাতে হবে। এ ছাড়া প্রতারক চক্রটি শিক্ষার্থীদের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, জন্মসাল, রোল নম্বর—এসব তথ্য ঠিকভাবে বলেছে। ফাঁদে পা দিয়ে ইতিমধ্যে কলেজের চার শিক্ষার্থী ও অভিভাবক ১ লাখ ৩ হাজার ৬০০ টাকা খুইয়েছেন। এক অভিভাবক থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন।

শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য কীভাবে প্রতারকের হাতে গেল, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রতারকেরা ফোন করে নাম-ঠিকানা সঠিকভাবে বলছেন। এতে প্রতারণার বিষয়টি বুঝে উঠতে কষ্ট হয়েছে। উপবৃত্তির আবেদনের পর এ ধরনের ফোন আসা শুরু হয়।

কলেজে শিক্ষকেরা প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়। এ জন্য একটি ফরম পূরণ করতে হয়। ফরমে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য থাকে। এসব তথ্য কলেজে জমা দেয় শিক্ষার্থীরা। পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ একটি ওয়েবসাইটে জমা করে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য থাকে শিক্ষা বোর্ড ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। ফলে কোনো এক জায়গা থেকে প্রতারক চক্র শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করেছে।

বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ গত ২৯ জানুয়ারি একটি জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রতি উপবৃত্তি প্রদানের নামে একটি প্রতারক চক্র ফোনে ছাত্র-ছাত্রী কিংবা তাদের অভিভাবকদের ব্যাংক হিসাব নম্বর, এটিএম কার্ড নম্বর, ওটিপি, পিন নম্বর, নগদ টাকা ইত্যাদি জমা দিতে বলেছে। এতে তারা কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের নাম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

কলেজ সূত্র জানায়, একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৪২৫। সরকারি উপবৃত্তির জন্য আবেদন শুরু হয় গত ৩০ অক্টোবর। শেষ হয় ৯ নভেম্বর। ব্যক্তিগত সব তথ্য দিয়ে আবেদন করেছে ৪৪০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী প্রতারক চক্রের ফোন পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের তথ্য প্রতারকের হাতে যাওয়ার বিষয়টি ইতিমধ্যে শিক্ষা বোর্ড এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) জানানো হয়েছে।

বাকলিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. জসীম উদ্দীন খান মনে করেন, উপবৃত্তির জন্য আবেদনে দেওয়া তথ্যই যেকোনো মাধ্যমে বেহাত হয়েছে। এর কারণ হিসেবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উপবৃত্তির আবেদনের পর সবার কাছে ফোন এসেছে। আর উপবৃত্তির আবেদন ফরমে দেওয়া তথ্যই প্রতারকেরা বলেছেন।

প্রতারকের ফাঁদে আরও যাঁরা

৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে আরেকজন অভিভাবককে ফোন করেন প্রতারক। ফোন করে প্রতারক শিক্ষার্থীর যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য অভিভাবককে জানান। ওই অভিভাবকও প্রতারকের কথার ফাঁদে পড়ে ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা খুইয়েছেন। মুঠোফোন আর্থিক সেবাদাতা একটি অ্যাপসের মাধ্যমে এসব টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্র। এ ঘটনায় ওই দিনই নগরের চান্দগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন অভিভাবক। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি তাঁরা তদন্ত করে দেখছেন।

একই রকমভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছে কলেজের একাদশের আরও দুই শিক্ষার্থী। ৩০ জানুয়ারি বেলা ১১টা ৩১ মিনিটে প্রথম শিক্ষার্থীর কাছে প্রতারকের ফোন আসে। আরেক শিক্ষার্থী ফোন পায় ২৯ জানুয়ারি। তারা দুজন মোট ১৮ হাজার টাকা খুইয়েছে।

দুই শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে জানায়, ফোন করে ওই প্রতারক তাদের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, রোল নম্বর, জন্মসাল—সব তথ্য বলেছেন। চারজন টাকা খোয়ালেও প্রতারকের ফোন পেয়েছেন এমন আরও ১৫ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক।

শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রতারক চক্রের হাতে যাওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্মৃতি কর্মকার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সফটওয়্যারের মাধ্যমে কলেজ থেকে শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করেন। ফলে তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অবশ্য এসব তথ্য কলেজ কর্তৃপক্ষ ও বোর্ডেও থাকে। তবে ঠিক কোন জায়গা থেকে প্রতারক চক্রের হাতে তথ্য গেছে, তা তদন্ত করে বের করতে হবে বলে জানালেন ট্রাস্টের সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির স্কিম পরিচালক মোহাম্মদ আসাদুল হক। তিনি সতর্ক করে বলেন, উপবৃত্তির টাকা পাওয়ার জন্য কোনো পর্যায়ে আর্থিক লেনদেন করা হয় না। ফলে কারও সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করা যাবে না।

‘তদন্ত হওয়া উচিত’

দেশে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনা আরও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম টেকক্রাঞ্চ গত জুলাইয়ে জানায়, বাংলাদেশের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্যভান্ডার থেকে লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে। এরপর একটি শিক্ষা বোর্ড থেকে তথ্য ফাঁসের খবর পাওয়া যায়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী ওয়্যারড গত নভেম্বরে জানায়, বাংলাদেশের একটি সংস্থার সংগ্রহ করা বাংলাদেশিদের ব্যক্তিগত তথ্য বেহাত হয়েছে।

আবার রাঙামাটিতে ৫০৬ জন দিনমজুর, জেলে, দুস্থ নারী, ভিক্ষুকসহ দরিদ্র মানুষের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে ‘জালিয়াতি’ করে ঋণ নেওয়া হয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে এই ঋণ নেওয়া হয়। তবে ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা ব্যাংকের নোটিশ পাওয়ার পর সম্প্রতি বিষয়টি জানতে পারেন। মূলত অপরাধীরা এসব মানুষের পরিচয় চুরি করে ব্যাংকঋণ নিয়েছে বলে পুলিশের তদন্তে বের হয়ে এসেছে। এর আগে ২০২০ সালে পঞ্চগড়ে অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের বিষয়টি সামনে এসেছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে প্রতারকেরা ব্যাংক হিসাব, ক্রেডিট কার্ড অথবা এমএফএস হিসাব থেকে টাকা নিয়ে নিতে পারে। এমনকি ব্যাংকঋণও নেওয়া হতে পারে। এ ধরনের অপরাধকে বলা হয় পরিচয় চুরি বা আইডেনটিটি থেফট। বিশ্বজুড়ে সাধারণ সাইবার অপরাধের একটি ধরন হলো এই পরিচয় চুরি।

ঠিক কোন মাধ্যম থেকে শিক্ষার্থীদের নাম-ঠিকানা প্রতারকের হাতে গেল, তা তদন্ত করে বের করা উচিত বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান আবু হাসনাত মোহাম্মদ আশফাক হাবীব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রতারকের হাতে যাওয়ার বিষয়টি ভয়ংকর। এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে প্রতারকেরা অনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারে। হয়তো আরও অনেক কলেজের শিক্ষার্থীদের তথ্য প্রতারকের হাতে থাকতে পারে। তাই তদন্ত করে দ্রুত জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে।