ভারতে আটক হওয়ার ৩৩ মাস পরও দেশে ফেরত আনা যায়নি সোহেল রানাকে।
অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে দেশে সোহেল রানার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা রয়েছে।
ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশের ঘটনায় সেখানকার একটি কারাগারে থাকা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক ও বরখাস্ত হওয়া বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সোহেল রানা কলকাতা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে পালিয়েছেন। এ ঘটনায় তাঁর জামিন বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
সোহেল রানা ভারতে আটক হওয়ার ৩৩ মাস পরও তাঁকে দেশে ফেরত আনা যায়নি। তবে বাংলাদেশের পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, ভারত থেকে তাঁকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাহুল তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, সোহেল রানাকে প্রতি সপ্তাহে সশরীর মেখলিগঞ্জ থানায় হাজির হওয়া ও থানার কাছাকাছি এলাকায় বাসা ভাড়া নেওয়ার শর্তে কলকাতার হাইকোর্ট জামিন দেন। জামিনের আবেদনে শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছিলেন তিনি। কিন্তু জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সোহেল রানা আর থানায় আসেননি। তাঁর আইনজীবী গত বছরের ৫ জানুয়ারি ফোনে মেখলিগঞ্জের ওসিকে জানিয়েছিলেন সোহেল রানা অসুস্থ, তাঁর থানায় আসা সম্ভব ন। ওসি অসুস্থ অবস্থায় সোহেলকে থানায় আনতে বলেন। কিন্তু আইনজীবী সেটি করেননি।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, ভারত থেকে সোহেল রানাকে দেশে ফেরানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
রাহুল তালুকদার বলেন, শর্ত না মানার বিষয়টি আদালতকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে লিখিতভাবে জানায় মেখলিগঞ্জ থানা–পুলিশ। এরপর আদালত সোহেল রানার জামিন বাতিল করেন। এরপর থেকে তিনি কোথায় আছেন, তা পুলিশ জানে না। তাঁর সাজা শেষ হওয়ার আর ছয় মাস বাকি ছিল।
ই-অরেঞ্জের প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সোহেল রানা ভারতে পালিয়ে যান। পরে ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে তিনি সেখানকার কারাগারে ছিলেন। প্রতারণার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সোহেল রানাকে বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি নেপথ্যে থেকে ই-অরেঞ্জ নামের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন।
বর্তমানে সোহেল, তাঁর স্ত্রী নাজনীন নাহার, বোন সোনিয়া মেহজাবিন ও ভগ্নিপতি মাশুকুর রহমানের নামে মোট ৯টি মামলা আছে। এসব মামলায় প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারসহ (মানি লন্ডারিং) বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। সোনিয়া ও মাশুকুর সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আর নাজনীন পলাতক।
বিদেশ থেকে অপরাধী ফিরিয়ে আনা, সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রক্ষার দায়িত্ব পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি)। যোগাযোগ করা হলে ব্যুরোর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ভারতে অনুপ্রবেশের মামলায় সোহেল রানার দুই বছরের কারাদণ্ড ও ৪০ হাজার রুপি জরিমানা হয়। পশ্চিমবঙ্গের আলীপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন তিনি। সেখান থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন।’
ই-অরেঞ্জের প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সোহেল রানা ভারতে পালিয়ে যান। পরে ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে তিনি সেখানকার কারাগারে ছিলেন।
পুলিশ বলছে, ঢাকায় সোহেল রানার বিরুদ্ধে ৯টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার বিচার চলার সময় তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা জরুরি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত ও বাংলাদেশ—দুই দেশের আইনে অনুপ্রবেশ একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ। দুই দেশের সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে তাঁকে ফিরিয়ে এনে বিচারের সম্মুখীন করার সুযোগ আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুরুতে সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পুলিশের তৎপরতা ছিল। এ নিয়ে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তর ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে আট দফা চিঠি চালাচালি করেছে। এরপর আর তাদের তৎপরতা চলার কথা জানা যায়নি। পুলিশের তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানাতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার এনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সোহেল রানা ভারতের আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে ভারতেই আছেন। তিনি যেসব শর্তে জামিন নিয়েছিলেন, সেসব শর্ত মানেননি। তাই তাঁর জামিন বাতিলের আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সোহেলের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি আছে। ভারতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিলম্ব হচ্ছে।
মামলাগুলোর অবস্থা
গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দেশের যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেগুলোর একটি ই-অরেঞ্জ। ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা হয়। এরপর সোহেল রানার নাম আলোচনায় আসে।
বর্তমানে সোহেল, তাঁর স্ত্রী নাজনীন নাহার, বোন সোনিয়া মেহজাবিন ও ভগ্নিপতি মাশুকুর রহমানের নামে মোট ৯টি মামলা আছে। এসব মামলায় প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচারসহ (মানি লন্ডারিং) বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। সোনিয়া ও মাশুকুর সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। আর নাজনীন পলাতক।
সোহেলের বিরুদ্ধে হওয়া ৯টি মামলার মধ্যে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের চারটি মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এসব মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন ডিএমপির তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সোহেল রানা ভারতের আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে ভারতেই আছেন। তিনি যেসব শর্তে জামিন নিয়েছিলেন, সেসব শর্ত মানেননি। তাই তাঁর জামিন বাতিলের আবেদন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সোহেলের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি আছে। ভারতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বিলম্ব হচ্ছেএনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) আলী হায়দার চৌধুরী
এ ছাড়া চারটি মামলা তদন্ত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি)। মামলাগুলোর তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতারণা করে গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোহেল রানা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি চারটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।’
আর সোহেলের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনের মামলা তদন্ত করছে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট। মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোহেলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একাধিক চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাঁর ব্যাপারে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটেও (বিএফআইইউ)। সোহেলের বিরুদ্ধে ২৫০ কোটি টাকার অপরাধলব্ধ আয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এদিকে গত শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সোহেল রানার বিরুদ্ধে হওয়া মানি লন্ডারিং আইনের মামলাটি তদন্তাধীন।
প্রতারণা করে গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোহেল রানা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি চারটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম