সরকারি সংস্থা বিসিআইসির আমদানি করা ৬২০ কোটি টাকার সার গুদামে পৌঁছে না দিয়ে ‘আত্মসাৎ’ করা হয়েছিল।
সরকারিভাবে আমদানি করা সার বন্দর থেকে খালাসের পর ৫০ দিনের মধ্যে গুদামে পৌঁছানোর কথা। তবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির আগে আমদানি করা ৬৪ হাজার মেট্রিক টন সার এখনো সরকারের গুদামে পৌঁছায়নি। তদন্তে উঠে এসেছে, ওই সার আত্মসাৎ করেছে পরিবহনের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সারের আমদানিকারক শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান রসায়ন শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি)। দেশে কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য ইউরিয়া সার উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। আবার ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে সার আমদানিও করে তারা। বিদেশ থেকে আমদানি করা সার পরিবহন ঠিকাদারদের মাধ্যমে বন্দর থেকে গুদামে নিয়ে আসে বিসিআইসি। প্রতিষ্ঠানটির যে সার আত্মসাৎ করা হয়েছে, তার দাম প্রায় ৬২০ কোটি টাকা।
সার আত্মসাতের ঘটনায় গত ডিসেম্বরে একটি মামলা করে বিসিআইসি। রাজধানীর মতিঝিল থানায় দায়ের করা ওই মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট সারগুলো আত্মসাতের তথ্য পেয়েছে।
এর জন্য দায়ী করে পরিবহন ঠিকাদার হিসেবে কাজ করা নবাব অ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ নবাব খানের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
সিটিটিসির উপকমিশনার (ডিসি) মো. জসীম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি করা ১ লাখ ৮৩ হাজার টন সার বন্দর থেকে সরকারের আপৎকালীন (বাফার) গুদামে পৌঁছে দিতে নবাব অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে ৭টি পরিবহন চুক্তি করে বিসিআইসি। এসব সার ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে খালাস হয়। কিন্তু বিসিআইসি বারবার তাগাদা দিলেও ৬৪ হাজার টন সার সরকারি গুদামে পৌঁছায়নি পরিবহন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
সারগুলো বন্দর থেকে খালাস করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় রাখে। কারণ, চট্টগ্রাম ও মোংলায় বিসিআইসির নিজস্ব গুদাম নেই। পরে সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
বিসিআইসি ৬৪ হাজার টন সার না পেয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) আবু সাঈদকে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরিয়া সার বন্দর থেকে খালাসের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ৯টি নিজস্ব গুদামে তা মজুত করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
৯টি গুদাম পরিদর্শন করে দেখা গেছে, সেখানে মজুত আছে ২৮ হাজার টন ইউরিয়া সার, যার দাম প্রায় ৩৭২ কোটি টাকা। আর হদিস নেই প্রায় ৩৬ হাজার টন সারের, যার দাম ৪৩৮ কোটি টাকা।
যে ২৮ হাজার টন সার গুদামে আছে, তা নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায়। ঠিকাদার বলছেন, বিসিআইসি এই সার নিচ্ছে না। অন্যদিকে বিসিআইসি বলছে, সারগুলো ঠিকাদার দেয়নি। এখন গুণাগুণ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই মোট ৬৪ হাজার টন সার আত্মসাতের মামলা করা হয়েছে।
মামলার বাদী বিসিআইসির কর্মকর্তা সাইফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও সরকারি গুদামে সার সরবরাহ না করায় কৃষক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমনকি সার সরবরাহে বারবার সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার পরও তা সরবরাহ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ কারণে সার আত্মসাতের অভিযোগ এনে মামলা করা হয়।
সিটিটিসি ও বিসিআইসির কর্মকর্তারা জানান, নবাবের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারার উত্তর বন্দর গ্রামে। তিনি ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। নবাব খুব বেশি পড়াশোনা করেননি। তিনি ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানার নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করতেন। ওই সময় তিনি কারখানায় নির্মাণশ্রমিক সরবরাহ শুরু করেন। ১৯৯১ সালে একজন সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তিনি চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানায় সার পরিবহনের ঠিকাদারির কাজ শুরু করেন।
সার আত্মসাতের মামলায় নবাবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়। পরে তিনি জামিন পান।
সার আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে নবাব অ্যান্ড কোম্পানির মালিক মোহাম্মদ নবাব খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে একটি চিঠির অনুলিপি পাঠান। গত জুনে সার পৌঁছে না দেওয়ার কারণ উল্লেখ করে এই চিঠি তিনি সিটিটিসির তদন্ত কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
চিঠিতে নবাব উল্লেখ করেন, যে সার আত্মসাতের কথা বলা হচ্ছে, তা যথাসময়ে বিসিআইসি গ্রহণ না করায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরে একাধিক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারের উচ্চতা এবং মহামারি ও লকডাউনের মতো কারণে সরকারি সার কম বিক্রি হয়। ফলে সারগুলো গুদামেই থেকে যায়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সারের ক্ষয়ক্ষতি, জমাট ও শক্ত হতে পারে।
নবাব চিঠিতে আরও বলেন, তিনি সার গ্রহণ করতে বিসিআইসিকে শত শত চিঠি দিয়েছেন। বিসিআইসি সার গ্রহণ করতে বললেও গুদামের তত্ত্বাবধায়ক মেয়াদোত্তীর্ণ ও পর্যাপ্ত জায়গা না থাকার অজুহাতে তা গ্রহণ করেননি।
অবশ্য বিসিআইসির তদন্তে বলা হয়েছিল, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে যথাসময়ে সার পৌঁছে দেওয়ার জন্য বারবার তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। তবে রক্ষা করেনি।
বিসিআইসির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, নবাব অ্যান্ড কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে আমদানি করা সার বন্দর থেকে সরকারি গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি একচেটিয়াভাবে পরিবহনের কাজটি করছিল। সার পৌঁছে না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৮ সালে দুটি দেশ থেকে আমদানি করা ১৩ হাজার টন টিএসপি সার সরকারের গুদামে পৌঁছে না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এর বাজারমূল্য ছিল সাড়ে তিন কোটি টাকা।
বিসিআইসির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি করা সার বাফার গুদামে পৌঁছে না দিয়ে আত্মসাতের ঘটনায় ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। এর মধ্যে নবাবের প্রতিষ্ঠান নবাব অ্যান্ড কোম্পানির নামও ছিল। ওই দুটি ঘটনায় নবাব বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।