চিকিৎসক সাবিরা হত্যাকাণ্ড

দুই বছর তদন্তের পর স্বামীকে আবার রিমান্ডে নেওয়ার কথা ভাবছে পুলিশ

চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমান
ফাইল ছবি

দুই বছর আগে কলাবাগানের ভাড়া বাসা থেকে চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমানের রক্তাক্ত ও অর্ধদগ্ধ লাশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ওই ঘটনায় হওয়া হত্যা মামলায় পুলিশ সাবিরা রহমানের স্বামী সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা এ কে এম সামছুদ্দিনকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিলেও হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে পারেনি।

তবে হত্যাকাণ্ডের প্রায় দুই বছর পর এসে এখন মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, রিমান্ডে এ কে এম সামছুদ্দিন পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছে। ওই হত্যাকাণ্ডে তিনি জড়িত বলে এখনো সন্দেহ করা হচ্ছে। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে তাঁকে সন্দেহ করার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তিনি এখন জামিনে মুক্ত। তাঁকে কীভাবে আবার রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে খুনের রহস্য উদ্‌ঘাটন করা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে এখন পিবিআই।

২০২১ সালের ৩১ মে কলাবাগানের ফার্স্ট লেনের একটি ভবনে ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে চিকিৎসক সাবিরা রহমানের (৪৬) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাঁর গলা কাটা ও পিঠে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল। ওই ঘটনায় কলাবাগান থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন সাবিরার মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার। সাবিরা রহমান রাজধানীর গ্রিন রোডে বেসরকারি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট (সনোলজিস্ট) ছিলেন।

সাবিরা রহমান কলাবাগানের যে ফ্ল্যাটে থাকতেন, সেটিতে তিনটি কক্ষ ছিল। একটি কক্ষে সাবিরা, বাকি দুটি কক্ষে দুই তরুণী থাকতেন। এর মধ্যে কানিজ সুবর্ণা মডেলিং করেন। অন্য তরুণী নুরজাহান ২০২১ সালে ঈদুল ফিতরের আগে বাড়িতে গিয়ে আর ঢাকায় ফেরেননি। তিনি সাবিরা রহমানকে পবিত্র কোরআন শরিফ পড়াতেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পিবিআই সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে কানিজ সুবর্ণা দাবি করেন, ঘটনার দিন সকাল ছয়টায় তিনি প্রাতর্ভ্রমণে যান। তখন সাবিরার কক্ষের দরজা বন্ধ ছিল। সকাল সাড়ে ৯টায় ফিরে এসে তিনি ওই কক্ষ থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেন। ওই বাসায় কেউ গেলে তাঁর নাম-ঠিকানা লিখে রাখার ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি ভবনের নিরাপত্তাকর্মী থাকলেও তিনি ঢোকার প্রধান ফটকে দায়িত্ব পালন না করে ওই ভবনের বাসিন্দাদের জন্য কেনাকাটা করতে দোকানে যেতেন। এ ছাড়া ওই ভবনসহ গলির আটটি বাড়িতেও কোনো সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা ছিল না। সাবিরার বাসার দরজা ভাঙার আলামত পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, খুনি হয়তো সাবিরার ঘনিষ্ঠজন। তিনি সাবিরার সঙ্গে বাসায় ঢুকে তাঁকে খুন করে স্বয়ংক্রিয় তালা মেরে চলে যান।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনের জন্য সাবিরা যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক, গৃহকর্মী, অন্য ভাড়াটে ও পাশের কক্ষের বাসিন্দাসহ সাবিরার সহকর্মী-স্বজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের পরিদর্শক জুয়েল দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, এখনো তাঁরা হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ বের করতে পারেননি। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক (কেয়ারটেকার) বেশির ভাগ সময় ভবনের বাসিন্দাদের দরকারি কেনাকাটা করতে দোকানে যেতেন। আর এই অবস্থায় বাড়ির প্রধান ফটক থাকত অরক্ষিত অবস্থায়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে খুনি বা খুনিরা।

জুয়েল দেওয়ান আরও বলেন, সাবিরার স্বামী এ কে এম সামছুজ্জামানকে সন্দেহ করার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সাবিরার সঙ্গে স্বামীর সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিল না। সাবিরার ভাড়া বাসায় স্বামী কয়েকবার গিয়েছিলেন সেটা তাঁর মুঠোফোনের কল লিস্ট পর্যালোচনা করে জানা গেছে। কাউকে না জানিয়েই তিনি সাবিরার বাসায় আসতেন। ঘটনার আগের রাতে সাবিরার সঙ্গে সবশেষ মুঠোফোনে কথা বলেন তিনি।

সামছুদ্দিন রাত ১০টা ৩৮ মিনিট থেকে টানা ২০ মিনিট ১৬ সেকেন্ড মেসেঞ্জারে কথা বলেছিলেন সাবিরার সঙ্গে। ঘটনার পর দিন ৩১ মে সকালে সামছুদ্দিনের মুঠোফোন বন্ধ ছিল। তা ছাড়া সামছুদ্দিনের বাসায় তাঁর গাড়িচালক সাইফুল ইসলাম কখনো থাকতেন না। হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে সামছুদ্দিনের বাসায় ছিলেন সাইফুল ইসলাম। এ ছাড়া সাবিরার রুমমেট কানিজ সুবর্ণাকে সন্দেহের তালিকায় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তদন্তে এসব বিষয়গুলো মেলানোর কাজ চলছে।

২০০৬ সালে এ কে এম সামছুদ্দিনের সঙ্গে সাবিরা রহমানের বিয়ে হয়। পরের বছর একটি মেয়েসন্তান হয় তাঁদের। এর আগে চট্টগ্রামের একটি মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ১৯৯৮ সালে উবাইদ উল্লাহ নামের এক চিকিৎসকের সঙ্গে সাবিরার বিয়ে হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে সেই ঘরে এক ছেলের জন্ম হয়।

২০০৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান উবাইদ উল্লাহ। সাবিরাকে বিয়ে করার আগে সামছুদ্দিন আরও দুটি বিয়ে করেছিলেন। এর মধ্যে একটি বিয়ের তথ্য গোপন করেছিলেন তিনি। বিষয়টি জানাজানির পর থেকে তাঁদের মধ্যে কলহ শুরু হয়।

মামলার অগ্রগতি নিয়ে কথা হয় মামলার বাদী রেজাউল হাসান মজুমদারের সঙ্গে। গতকাল শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাবিরার খুনে কয়েকজনকে সন্দেহ করছেন তিনি। ঘটনার আগের রাতে সামছুদ্দিনের বাসায় তাঁর গাড়িচালকের থাকাটা অস্বাভাবিক। এ ছাড়া সাবিরার রুমমেট কানিজ সুবর্ণা ও ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়কে সন্দেহ তাঁর। খুনের কয়েক দিন আগে ওই ভবনের ওপরের তলার এক ভাড়াটে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো হত্যাকাণ্ডের কারণ বেরিয়ে আসতে পারে। তিনি বলেন, সাবিরা হত্যাকাণ্ডের প্রায় দু বছর হতে চলল। এখনো সাবিরাকে কারা এবং কেন খুন করেছে, তা জানতে পারিনি। সাবিরার ছোট ভাই অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত প্রকৌশলী কাজী ওবায়দুর রহমান বোনের হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে গত সপ্তাহে দেশে এসেছিলেন। দ্রুততম সময়ে সাবিরার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে এটাই প্রত্যাশা তাঁদের। হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটনে পিবিআই প্রয়োজনে অন্য কোনো সংস্থার সহযোগিতা নেবে বলে আশা করছেন তাঁরা।