দেশের সংবাদপত্রগুলোয় ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শিশুহত্যার খবর প্রায় তিন গুণ বেশি প্রকাশিত হয়েছে। ২০২১ সালে ১৮৩টি শিশু হত্যার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯৭টিতে। তবে এই এক বছরে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি—১ হাজার ৪১৯টি। যা ২০২১ সালের তুলনায় তিন গুণের বেশি। এ ছাড়া এই এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া শিশু নিয়ে সংবাদ প্রকাশও বেড়েছে প্রায় তিন গুণ—১৯৬টি। তবে এই সময়ে বাল্যবিবাহ ও ধর্ষণের ঘটনার খবর উল্লেখযোগ্যভাবে কম প্রকাশিত হয়েছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। দেশের আটটি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত শিশুবিষয়ক খবর সংকলিত করে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে ‘এমজেএফের শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২২’ শিরোনামে উপস্থাপন করা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, এক বছরে ১২টি ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। সেগুলো হলো যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, সড়ক দুর্ঘটনা, অন্যান্য দুর্ঘটনা, অপহরণ, হত্যা, নির্যাতন, আত্মহত্যা, অপরাধে সংশ্লিষ্ট শিশু, নিখোঁজ ও পানিতে ডুবে মৃত্যু। এসব ক্ষেত্রে ২০২১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৬টি। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৯৪, অর্থাৎ এক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর হার বেড়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২১ সালে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছিল ৪১ হাজার ৯৫টি শিশু। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৩০১, যা আগের বছরের তুলনায় ৯৪ শতাংশ কম।
বাল্যবিবাহ এতটা কমার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, বড় ধরনের কোনো জরিপ ছাড়া বাল্যবিবাহ কমেছে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলার সুযোগ নেই। কারণ, বাল্যবিবাহ চলছেই। তিনি বলেন, কোভিডের পর সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের একটি ছিল শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়া। তবে কোভিডের সময়ে নিম্ন আয়ের অনেক শিশু বাধ্য হয়েছে শ্রমে যুক্ত হতে। তাই সব শিশুর সুরক্ষায় সরকারি পর্যবেক্ষণ ও তদারকি আরও শক্তিশালী করতে হবে। শিশুদের ব্যাপারে অভিভাবক ও শিক্ষকদের আরও সচেতন হতে হবে।
শিশু পরিস্থিতি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এমজেএফের সমন্বয়কারী রাফেজা শাহীন। প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় বলা হয়, এটা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে শিশু অধিকার পরিস্থিতির সাম্প্রতিক প্রবণতা তুলে ধরে, সারা দেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতির পরিপূর্ণ চিত্র নয়। কারণ, অনেক খবর পত্রিকার পাতায় আসে না।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ২০২২ সালে আটটি সংবাদপত্রে শিশুবিষয়ক ৬৭টি ইতিবাচক ও ২ হাজার ২৮টি নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এমজেএফের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী (গণমাধ্যম ও যোগাযোগ) শাহানা হুদা বলেন, ছোট শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। ছোট শিশুরা প্রতিহত করতে পারে না, ভয়ে ঘটনা গোপন করে। ফলে তারা প্রতিবেশী ও স্বজনদের মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন করতে গণমাধ্যমের ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনার বাইরে ৩১১টি শিশু অন্যান্য দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এই বছরে ৫৬০ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা আগের বছরের (২০২১) তুলনায় প্রায় ৩২ শতাংশ কম। ২০২২ সালে ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ৯৮টি শিশু, যা আগের তুলনায় কিছুটা বেশি। এ ছাড়া ২০২২ সালে ৯৬টি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার, ৩০ শিশু অপহরণ, ৬৮ শিশু নির্যাতন, ৩৩ শিশু নিখোঁজ ও ৯টি শিশুর বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্ট হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে ৪৪টি শিশুর আত্মহত্যা করার খবর এসেছে সংবাদপত্রগুলোতে।
সংবাদ সম্মেলনে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. এমরান খান বলেন, তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সরকার কোথায় ঘাটতি ও কোথায় সক্ষমতা আছে, তা নিয়ে কাজ করছে। শিশু সুরক্ষায় সমাজকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার ঠেকাতে অভিভাবকদের শিশু সুরক্ষা ভাতা দেওয়া হবে।
অনেক পরিবারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে বেসরকারি সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা বেগম বলেন, যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে একটি শিশুর ডানা ভেঙে দেওয়া হয়। ওই শিশু আর বিকশিত হতে পারে না।
কুষ্টিয়ার মুক্তি নারী ও শিশু উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মমতাজ আরা বেগম বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেই চলেছে। অন্য জায়গায় নিয়ে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অনেক নির্যাতনের খবর পত্রিকায় আসে না, এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে কমিউনিটি পারটিসিপেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোসলেমা বারী বলেন, সন্তানদের বিষয়ে মা–বাবাকে সচেতন করার শিক্ষা দেওয়া জরুরি।