মা–বাবার কলহ, ক্ষোভ, অভিমানের বলি হচ্ছে শিশুরা

শিশু নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

১৪ বছরের সংসার ছিল এস এম সেলিম (৩৪) ও মাহামুদা হকের (৩৩)। সংসার আলো করে এসেছিল দুই সন্তান। সম্প্রতি স্ত্রী মাহামুদা ও বড় মেয়ে সানজা মারওয়াকে (১০) দুধের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে সেলিমের বিরুদ্ধে। পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় এরই মধ্যে তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।

২১ জুন রাজধানীর বাড্ডার আনন্দনগরে মাহামুদার পরিবারের সঙ্গে কথা হয়। মাহামুদার মামা সোহেল শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, বিয়ের পর সেলিম বেশ কয়েকবার অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর কলহ হতো। সম্প্রতি সেলিম আবার এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। মাহমুদা সে কথা মা ও বোনকেও জানিয়েছিলেন।

সেলিম-মাহমুদা দম্পতির আরেক সন্তানের বয়স ৯ মাস, নাম সারিম মারওয়ান। শিশুটিকে এখন দেখভাল করছেন মাহামুদার মা জুঁই বেগম। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, মা মারা যাওয়ার পর থেকে সারিম সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। মাকে খোঁজে। বুকের দুধ চায়।

২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রথম আলোয় প্রকাশিত সন্তানসহ হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত ২৩টি খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর কলহ থেকে নৃশংসভাবে প্রাণ যাচ্ছে সন্তানের। কখনো রাগ-ক্ষোভ-অভিমান, একে অপরকে ‘শিক্ষা দেওয়া’ বা ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার প্রবণতা, কখনো পরকীয়ার জের কিংবা অপরাধমূলক মনোভাব থেকে মা-বাবা নিজ সন্তানকে হত্যা করেছেন।

কিছু মানুষ বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত। এই বোধের কারণে সন্তান বা পরিবারের কারও প্রতি তাঁদের মায়া থাকে না। শিশুরাই এই ব্যক্তিদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়। মানসিক নৈরাজ্য থেকেও স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ঘায়েল করতে সন্তানকে আঘাত করেন। 
আমানুল্লাহ ফেরদৌস, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ওই সব হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে তিনটি ঘটনা ছিল পরকীয়ার কারণে স্ত্রীসহ সন্তান হত্যা। সন্তানসহ আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করা হয়েছে পাঁচটি ক্ষেত্রে। আর্থিক সংকট থেকে হতাশা ও কলহ থেকে স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যার ঘটনা তিনটি। স্ত্রীকে সন্দেহ করে সন্তানসহ হত্যার ঘটনা দুটি। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যার ঘটনা একটি। আর অন্য কলহ থেকে সন্তানসহ হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৯টি।

এ ছাড়া ২৩টি ঘটনার মধ্যে একটিতে বাবা ও মেয়ে হত্যার ঘটনায় স্ত্রী জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এর বাইরে আরও তিনটি ঘটনায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বগুড়ায় বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় সন্তানসহ মাকে হত্যা করা হয়। ২০২০ সালে পাবনার একটি ঘটনায় বাড়িতে ঢুকে মা-বাবা ও পালিত শিশুকন্যাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনাকে ডাকাতি বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ জুন নোয়াখালীতে আর্থিক বিরোধ থেকে বাড়িতে ঢুকে মা ও মেয়েকে হত্যার ঘটনা ঘটে।  

স্ত্রীকে মারতে দুধে ঘুমের ওষুধ, প্রাণ গেল শিশুসন্তানেরও

বাড্ডার মাহামুদা হক ও সানজা মারওয়া হত্যা মামলা নিয়ে জানতে ২১ জুন বাড্ডা থানায় গিয়ে কথা হয় পরিদর্শক (অপারেশন) নূর আলম মাসুম সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি বলেন, সেলিমের অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেছেন, শুধু স্ত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে দুধের সঙ্গে ৩০টি ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিলেন। সেই দুধ মেয়েও যে খাবে, তা তিনি বোঝেননি। সেলিম এখন কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।

মাহামুদার মা জুঁই বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েটা মাঝেমধ্যেই বলত, “মা, আমি কখনো আত্মহত্যা করব না। যদি শোনো, আমি মরে গেছি, বুঝবা আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে।” সংসার টিকিয়ে রাখতে মেয়ে সব অত্যাচার সহ্য করেছে। স্বামী-সংসারের মায়া ছেড়ে আসতে চাইত না।’

বাড্ডায় অর্কিড জমশেদ টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাটে মেয়েসহ মাহামুদা খুন হয়েছেন। ওই ভবনের দুটি ফ্ল্যাট আর দুটি দোকান পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে পেয়েছেন সেলিম।
জুঁই বেগম বারবার বলছিলেন, ‘আমার টাকা নাই, বিচার পাব তো?’ তিনি জানান, নাতি সারিম মারওয়ানকে নিয়ে মুন্সিগঞ্জের গ্রামে তাঁর টানাটানির সংসারে ফিরে যাবেন।

২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রথম আলোয় প্রকাশিত সন্তানসহ হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত ২৩টি খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর কলহ থেকে নৃশংসভাবে প্রাণ যাচ্ছে সন্তানের। কখনো রাগ-ক্ষোভ-অভিমান, একে অপরকে ‘শিক্ষা দেওয়া’ বা ‘প্রতিশোধ’ নেওয়ার প্রবণতা, কখনো পরকীয়ার জের কিংবা অপরাধমূলক মনোভাব থেকে মা-বাবা নিজ সন্তানকে হত্যা করেছেন।

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে, অনটন-কলহে হত্যা

২০২২ সালের ২২ মে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার রাহিমা বেগম (৩৫) এবং তাঁর দুই সন্তান রাব্বি শেখ (১৩) ও রাকিবা শেখের (৭) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে রাহিমার স্বামী গিয়াস উদ্দিন শেখ পুলিশের জেরার মুখে স্বীকার করেন, জমি নিয়ে বিরোধে চাচাতো ভাইকে ফাঁসাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে ঘুমন্ত অবস্থায় ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন তিনি।

এ ঘটনায় করা মামলার বাদী নিহত রাহিমার ছোট ভাই মো. মোশারফ হোসেন গত রোববার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গিয়াস রাতের কোনো এক সময়ে বাড়িতে ঢুকে স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করে গাজীপুরে চলে যান। পরে তাঁদের ফোন দিয়ে উল্টো গল্প ফাঁদেন। মোশাররফ জানান, এক বছর ধরে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে।
আসামি গিয়াস উদ্দিনের ছোট ভাই রেজু শেখের মুঠোফোনে কল করলে তাঁর স্ত্রী ফরিদা ধরেন। তিনি জানান, গিয়াস হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। এখন নরসিংদী জেলা কারাগারে আছেন।

২০২২ সালের ৮ মে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার আসাদুজ্জামান নামের এক ব্যক্তি তাঁর স্ত্রী লাভলী আক্তার (৩৫) এবং দুই মেয়ে ছোঁয়া (১৬) ও কথাকে (১২) গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে আসাদুজ্জামান ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানান, ঋণগ্রস্ত থাকার কারণে পারিবারিক কলহ থেকে এ হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন।

মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মানিকগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আমিনুল ইসলাম গত শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে।

২০২১ সালের ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশে একটি ভবনের চারতলা থেকে সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত অবস্থায় সুমিতা খাতুন ও ছেলে সান (৩) এবং বিছানায় শোয়া অবস্থায় মেয়ে মুনের (৭) মরদেহ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে সুমিতার স্বামী সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।

সুমিতার চাচাতো বোনের স্বামী সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার উপপরিদর্শক মো. আজমল হোসেন গত ২৪ জুন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সুমিতার পরিবার দরিদ্র। সুমিতা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন।

দারিদ্র্যের কারণে তাঁকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় মানসিক রোগ থেকে সুস্থ হওয়া সোহেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, পরে হারবাল ওষুধের দোকান দিয়ে অল্প সময়ে চট্টগ্রামে বাড়িসহ অনেক সম্পদ করেছেন সোহেল। এটা খুবই সন্দেহজনক। তাঁর অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।

২০২০ সালের ১৬ মে রংপুরে হাফিজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির (৩০) ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘরে পড়ে ছিল স্ত্রী ফাতেমা বেগম (২৫) ও দেড় বছরের মেয়ে হোমায়রার লাশ। তাঁদের গলায় ছুরিকাঘাতের আঘাত ছিল। ঘটনার আগে কয়েক দিন ধরে স্বামী-স্ত্রীর কলহ চলছিল।

এর আগে ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর চাঁদপুরে পারিবারিক কলহ থেকে স্ত্রী ফাতেমা বেগম (২৪), মেয়ে মিথিলা (৫) ও ছেলে সিয়ামকে (১) হত্যা করে আত্মহত্যার অভিযোগ ওঠে মাইনুদ্দিন সরদার নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে। এ ঘটনার আগে মাইনুদ্দিন ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন, তিনি আত্মহত্যা করবেন।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মো. মনজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে, এটা বলা যায় না। কখনো ঘটনা কম থাকে, কখনো বেশি থাকে। প্রত্যেক ক্ষেত্রে পুলিশ আইনি ব্যবস্থা নেয়।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ বছরে ২ হাজার ৯১৩ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। পারিবারিক বলয়ে হত্যার শিকার হয়েছে ৩৮৮টি শিশু। হত্যার শিকার শিশুদের মধ্যে ৬ বছরের কম বয়স ৬৭৬টির।  

নানা কারণে বাড়ছে এ ধরনের অপরাধ

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ বছরে ২ হাজার ৯১৩ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। পারিবারিক বলয়ে হত্যার শিকার হয়েছে ৩৮৮টি শিশু। হত্যার শিকার শিশুদের মধ্যে ৬ বছরের কম বয়স ৬৭৬টির। নয়টি জাতীয় পত্রিকা থেকে তথ্য নিয়ে এবং নিজস্ব প্রক্রিয়ায় সেসব তথ্য সংকলন করে এ তথ্য দিয়েছে আসক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আমানুল্লাহ ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, কিছু মানুষ বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত। এই বোধের কারণে সন্তান বা পরিবারের কারও প্রতি তাঁদের মায়া থাকে না। শিশুরাই এই ব্যক্তিদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়। মানসিক নৈরাজ্য থেকেও স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ঘায়েল করতে সন্তানকে আঘাত করেন।

আমানুল্লাহ ফেরদৌস বলেন, বর্তমান সমাজে কিছু মানুষের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চেয়ে অর্থনৈতিক চিন্তা প্রাধান্য পাচ্ছে। তখন অর্থের কাছে সম্পর্ক গুরুত্বহীন হয়ে যায় বলে সন্তানকে হত্যা করতেও তাঁদের খারাপ লাগে না। এ ছাড়া আইনের দীর্ঘসূত্রতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় অন্যান্য অপরাধের মতো এ অপরাধও বাড়ছে।