মা–বাবার ছাড়াছাড়ির পর বাবার হাত ধরে ঢাকা শহরে চলে আসে ছয় বছরের আফরিন। ঢাকার মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় একটি টিনশেড বাসায় ঠাঁই হয় তার। সেখানে বাবা মতিয়ার রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী মোসা. ফুলি খাতুনের (২৬) কাছে থাকত মেয়েটি। আর আফরিনের মা বড় মেয়েকে নিয়ে থাকতেন যশোরে।
৬ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে নিজেদের বাসার পাশের বাড়ির একটি পানির ট্যাংক থেকে আফরিনকে তোলা হয়। পানি নিতে আসা এক প্রতিবেশী নারী ট্যাংকে শিশুর স্যান্ডেল ভেসে থাকতে দেখে সন্দেহ হলে সেখানে তল্লাশি চালিয়ে মেয়েটিকে ডুবন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
খেলতে গিয়ে অসাবধানতাবশত মেয়েটি ট্যাংকে পড়ে যায় বলে ধারণা করেন সবাই। কিন্তু পরে বেরিয়ে এসেছে, সৎমা ফুলি খাতুনই মেয়েটিকে মাটি খুঁড়ে ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি করা পানির ট্যাংকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছেন। এ ঘটনায় ১২ জানুয়ারি রাজধানীর কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন আফরিনের মা সোনিয়া খাতুন (২৫)। সেখানে তিনি লিখেছেন, মেয়ের ময়নাতদন্ত শেষে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। এরপর মেয়ের বাবা ঢাকায় ফিরে দ্বিতীয় স্ত্রী ফুলিকে মনমরা থাকতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি আফরিনকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। বলেন, তাঁর ভুল হয়ে গেছে।
মামলা হওয়ার পরপরই গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী থেকে ফুলি খাতুনকে গ্রেপ্তার করে কাফরুল থানার পুলিশ। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও তিনি এই হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেন বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাফরুল থানান উপপরিদর্শক (এসআই) হোসনা আফরোজা জানান। পরে গত শনিবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ফুলি খাতুন। এরপরে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
এত ছোট একটি মেয়েকে কেন হত্যা করলেন, সে কথা ফুলি খাতুন নিজেই জানিয়েছেন বলে মামলার নথি ও পুলিশের বক্তব্যে উঠে এসেছে। কাফরুল থানা-পুলিশ আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামি ফুলি খাতুন স্বীকার করেছেন, সেদিন (৬ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে নয়টার পর সোহাগ (৩৫) নামে ফুলির এক ফুফাতো ভাই তাঁদের বাসায় আসেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে তাঁদেরকে কাছাকাছি অবস্থায় দেখে ফেলে আফরিন। তখন সে ফুলি খাতুনকে বলে, বাবা এলে সব বলে দেবে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ফুলি ও সোহাগ। দুজনে বুদ্ধি করে মেয়েটিকে পানির ট্যাংকে ফেলে দেয়। সোহাগের পরামর্শে পাশের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আফরিনকে ট্যাংকে ফেলে দেন ফুলি খাতুন।
তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হোসনা আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটিকে পানির ট্যাংকে ফেলে নিজের বাসায় চলে আসেন ফুলি খাতুন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবার বেরিয়ে পাশের বাড়িতে গিয়ে লোকজনকে বলেন, আফরিনকে তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। আশপাশে মেয়েটিকে খুঁজতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে শারমিন নামের এক প্রতিবেশী নারী ওই ট্যাংক থেকে পানি তুলতে গিয়ে সেখানে শিশুর স্যান্ডেল ভেসে থাকতে দেখেন। এরপর ওই প্রতিবেশী ফুলি খাতুনসহ অন্যদের ডেকে আনেন। তখন তল্লাশি চালিয়ে ট্যাংকের ভেতর থেকে আফরিনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
ওই দিনই এ ঘটনায় কাফরুল থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। এই মামলারও তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন এসআই হোসনা আফরোজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটির মৃত্যুর পর ফুলি খাতুনের আচরণ দেখে তাঁর সন্দেহ হয়। বিষয়টি তিনি আফরিনের বাবা মতিয়ার রহমানকে বলেছিলেন। মতিয়ারের কাছেও ফুলি খাতুনের আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়।