‘কিশোর গ্যাং’ নেতা পার্থ চৌধুরী ওরফে জুলোকে গত ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের বায়েজীদ বোস্তামী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা ও পটিয়া থানা–পুলিশ
‘কিশোর গ্যাং’ নেতা পার্থ চৌধুরী ওরফে জুলোকে গত ৩০ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের বায়েজীদ বোস্তামী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা ও পটিয়া থানা–পুলিশ

‘জুলো বাহিনী’র নাম নিতেও ভয়

বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে সশস্ত্র মহড়া। দলবল নিয়ে সরকারি হাসপাতালের ভেতর ঢুকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের দুই নেতাকে কোপানো। দিনদুপুরে মানুষ খুন করে উল্লাস। পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি। সংক্ষেপে এই হলো জুলো বাহিনীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড।

পুরো নাম পার্থ চৌধুরী ওরফে মহসিন চৌধুরী ওরফে জুলো, বয়স ৩৬। চট্টগ্রামের পটিয়ায় সবাই তাঁকে চেনে কিশোর গ্যাং নেতা ‘জুলো বাহিনীর’ প্রধান হিসেবে। এ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৫০। মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, ডাকাতি, জায়গা দখল, নারী উত্ত্যক্তকরণসহ নানা অপরাধে জড়িত এই বাহিনী। জুলোর নাম নিতেও ভয় পান স্থানীয় বাসিন্দারা।

তবে ২৭ এপ্রিলের পর পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টেছে। মাদক বিক্রির টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে ওই দিন রাজু হোসেন ওরফে গুলি রাজুকে ছুরিকাঘাতে খুন করে জুলো বাহিনী। এরপর পুলিশ এক সহযোগীসহ জুলোকে গ্রেপ্তার করে। তবে বাহিনীর অন্য সদস্যরা ধরা না পড়ায় স্থানীয় মানুষের আতঙ্ক কাটেনি।

আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই জানিয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, জুলো ও তাঁর এক সহযোগীকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

চট্টগ্রাম নগর ও পটিয়ায় জুলোর বিরুদ্ধে খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী নির্যাতন ও মারামারির ১১টি মামলা রয়েছে। নিজেকে যুবলীগের নেতা পরিচয় দিলেও তাঁর দলীয় কোনো পদ নেই। তবে পটিয়া উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ডি এম জমির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত জুলো। আর জমির হলেন সংসদ সদস্য ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরীর অনুসারী।

অভিযোগ আছে, জমির উদ্দিনের প্রশ্রয়ে জুলো বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। জমিরের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশে জুলো দলবল নিয়ে অংশ নেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন পটিয়ার যুবলীগ নেতা জমির উদ্দিন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, জুলো তাঁদের দলের কেউ নন। প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। একটি সমাবেশে হয়তো এসেছিলেন। জুলোকে বেওয়ারিশ উল্লেখ করে শাস্তি দাবি করেন জমির।

১৫০ সদস্যের বাহিনী

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া মুনসেফ বাজারের কাছে পৌরসভার সুচক্রদণ্ডী এলাকায় জুলো বাহিনীর মূল আস্তানা। আশপাশের নির্জন বিলে চলে মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ। জুলোর ডান হাত ছিল রাজু হোসেন ওরফে গুলি রাজু। মাদক ব্যবসার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে গত ২৭ এপ্রিল দিনদুপুরে রাজুকে সুচক্রদণ্ডী এলাকার একটি বিলে খুন করা হয়। একবার গ্রেপ্তারের পর র‍্যাবের হাত থেকে পালাতে গিয়ে পায়ে গুলি লাগে রাজুর। তখন থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘গুলি রাজু’।

পার্থ চৌধুরী ওরফে জুলো

পটিয়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রূপক কুমার সেন প্রথম আলোকে বলেন, জুলো ও তাঁর লোকজনের ভয়ে বাসিন্দারা আতঙ্কগ্রস্ত। মাদক, কিশোর গ্যাং, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে তারা জড়িত।

পুলিশ জানায়, চট্টগ্রাম নগরের অক্সিজেন ও জেলার পটিয়া পৌরসভা এলাকায় ১৫০ সদস্যের বাহিনী রয়েছে জুলোর। তাঁর বাহিনীতে ১৫ থেকে ১৬ বছরের কিশোর থেকে শুরু করে ৪০ বছর বয়সী লোকও রয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজু বাহিনীর ডান হাত হিসেবে পরিচিত জোবায়ের, তাইজু ইসলাম ওরফে আরমান, মো. সাকিব, মো. মিছবাহ, মো. আসফি, আয়াত, হাকিম চৌধুরী, সানায়েত আবিদ, মো. ফরমান সব সময় জুলোর সঙ্গে থাকেন।

গত রোববার পটিয়া পৌরসভা এলাকায় গেলে স্থানীয় লোকজন জুলোর ভয়ে মুখ খুলতে রাজি হচ্ছিলেন না। পৌরসভার পল্লী মঙ্গল এলাকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, জুলো বাহিনীর লোকজন তাঁর দোকান থেকে যখন যা খুশি নিয়ে যান। কিছু টাকা দিলেও বেশির ভাগই বাকি থাকে। দুই মাস আগে প্রতিবাদ করায় মারধর করা হয়।

সরেজমিন ঘুরে পটিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে জুলো বাহিনীর কিশোর গ্যাং ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করে। মোটরসাইকেলের হাইড্রোলিক হর্ন বাজিয়ে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তবে গত মাসের শেষের দিকে রাজুর খুনের পর থেকে এরা গা ঢাকা দিয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, জুলো বাহিনী প্রায়ই এলাকায় ছিনতাই করে থাকে। সন্ধ্যার পর এলাকায় চলাফেরা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ২০২২ সালের ১১ মার্চ লবণ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় জুলো বাহিনী। এ ঘটনায় জুলোর বিরুদ্ধে মামলা হয়, পুলিশ অভিযোগপত্রও দেয়। ওই লবণ ব্যবসায়ী জানান, মামলাটির বিচার চলছে। এখনো টাকা পাননি তিনি।

জুলো ও তাঁর সাত সহযোগীর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি পটিয়া বরলিয়া কর্তলা এলাকায় ডাকাতির মামলা হয়। মামলার বাদী মো. ইসমাইল প্রথম আলোকে বলেন, জুলো ও তাঁর সশস্ত্র বাহিনী চারটি ঘরে ঢুকে মালামাল নিয়ে যায়। মামলা করে এখন ভয়ে থাকেন।

খুন করে উল্লাস

নিজ দলের রাজুকে খুন করে দলবল নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন জুলো। গত রোববার পটিয়া পৌরসভার সুচক্রদণ্ডী পল্লী মঙ্গল এলাকায় গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা এ কথা জানান। সেদিনের ঘটনার পর থেকে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয় লোকজন জানান, খুনের পর সন্ত্রাসীরা রাজুর বাড়ির লোকজনের উদ্দেশে চিৎকার বরে বলতে থাকে, রাজুকে মেরে ফেলা হয়েছে, লাশ নিয়ে যান। রাজুর একজন প্রতিবেশী বলেন, দিনদুপুরে খুন করে আবার বাসার সামনে এসে বলে গেছে লাশ নিয়ে আসতে। এরা কতটা বেপরোয়া বুঝতে পারেন!

নিহত রাজুর মা নুরুন্নেছা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে আগে জুলোর দলে ছিল। এখন ভালো হয়ে যাওয়ায় তারা রাজুকে ডেকে নিয়ে বাড়ির পাশে খুন করেছে। এ ঘটনার বিচার চান তিনি।

ধরতে গেলেই পুলিশকে গুলি

জুলো এতটাই দুর্ধর্ষ যে পুলিশ ধরতে গেলেই গুলি ছুড়তে থাকেন। গুলিতে নগরের দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছিলেন ছয় বছর আগে। এ ঘটনায় করা মামলার বিচার চলছে। ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নগরের ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় পাঁচলাইশ থানার পুলিশ তল্লাশিচৌকি বসায়। ওই সময় মোটরসাইকেলকে থামার সংকেত দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালান জুলো।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নগর পুলিশের অফিসার্স মেসের ইনচার্জ এসআই পলাশ চন্দ্র ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন তাঁর মেরুদণ্ডে গুলির আঘাত লাগে। পরে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হন। তাঁর এক সহকর্মী পাঁচলাইশ থানার তৎকালীন এএসআই আবদুল মালেকের পায়ে গুলি লাগে। তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হলেও এখনো খুঁড়িয়ে হাঁটেন।

দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী জুলো চট্টগ্রাম-পটিয়া দুই জায়গাতেই থাকেন। গত ৩০ এপ্রিল জুলোকে ধরতে পুলিশ নগরের বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় অভিযান চালায়। চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জায়েদ মোহাম্মদ নাজমুন নুর প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার এড়াতে জুলো এক বাসা থেকে আরেক বাসার ছাদ ও দেয়াল টপকে যেভাবে লাফ দিয়েছে, তা সব আসামির পক্ষে সম্ভব না। আশপাশের এলাকা ঘিরেও চার ঘণ্টার অভিযান শেষে পুলিশ তাঁকে অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেপ্তার করে।

জুলোর পরিচয়

পটিয়া পৌর সদরের সুচক্রদণ্ডী এলাকার পুলক চৌধুরীর ছেলে পার্থ চৌধুরী ওরফে মহসিন চৌধুরী ওরফে জুলো চৌধুরী। পড়ালেখা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। চট্টগ্রাম শহরে মোটরসাইকেলের গ্যারেজসহ বিভিন্ন দোকানে কাজ করেন। শহরে থাকার সময় নগরের শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রয়াত অমিত মুহুরীর সংস্পর্শে এসে কিশোর বয়সে জড়িয়ে পড়েন অপরাধজগতে। পুলিশের তালিকায় থাকা ১১টি মামলার মধ্যে নগরের বিভিন্ন থানায় ছিনতাই, চুরির মামলা রয়েছে চারটি। খুনসহ বাকি ৭টি পটিয়া থানায়।

জুলোর কারণে গ্রামের বাড়ি পটিয়ায় থাকেন না মা প্রান্তিকা চৌধুরী। জুলোর চাচা রূপম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জুলোর সঙ্গে তাঁদের কারও কোনো যোগাযোগ নেই।