মীর মোহাম্মদ শাহারুজ্জামান বেসরকারি ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম বিভাগে কর্মরত ছিলেন। প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ এই ব্যাংক কর্মকর্তা তিন বছরে অভিনব কৌশলে ব্যাংকটির এটিএম বুথ থেকে আড়াই কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এই অর্থ আত্মসাতে তাঁকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী সায়মা আক্তার। সায়মার সমন্বয়ে এসব অর্থ আত্মসাতে যুক্ত ছিলেন এই দম্পতির পাঁচ সহযোগী।
এই টাকা আত্মসাতের জন্য শাহারুজ্জামান জোগাড় করেন ৬৩৭টি এটিএম কার্ড। পরে সহযোগীদের দিয়ে ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের ৩৯টি বুথ থেকে তুলে নেন ২ কোটি ৫৭ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এ ঘটনায় শাহারুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রীসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শাহারুজ্জামান প্রযুক্তিজ্ঞানে দক্ষ।
তিনি সহযোগীদের এটিএম কার্ড দিয়ে বুথে পাঠাতেন। টাকা উত্তোলনের পর এটিএম কার্ড নম্বরের বিপরীতে যে খুদে বার্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাংকের কেন্দ্রীয় সার্ভারে চলে যায়, সেটি তিনি বন্ধ করে দিতেন। এরপর ওই কার্ডধারীকে দিয়ে ব্যাংকে অভিযোগ করাতেন, কার্ড থেকে তাঁর টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি টাকা পাননি। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁর অভিযোগ তদন্ত করে ওই কার্ডের বিপরীতে টাকা পরিশোধ করে দিত।
প্রতারণার এ ঘটনায় মীর শাহারুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের পাঁচ সহযোগী আসাদুজ্জামান আসাদ, মেহেদী হাসান মামুন, আল আমিন, মোহাম্মদ সেলিম ও মোহাম্মদ আবদুল মালেককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে শাহারুজ্জামান, সেলিম ও মালেক পলাতক।
প্রতারণার মাধ্যমে ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের এ ঘটনা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের নজরে আসে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন তারা তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে শাহারুজ্জামানের জালিয়াতির বিষয়টি উঠে আসে। পরে গত বছরের ৮ এপ্রিল ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মশিউর রহমান বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
মামলার অভিযোগপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার ছেলে মীর মোহাম্মদ শাহারুজ্জামান ডাচ্–বাংলা ব্যাংকে যোগ দেন ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির এটিএম অপারেশন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। জালিয়াতির কাজে তাঁকে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন স্ত্রী সায়মা আক্তার। পেশায় তিনি তৈরি পোশাক ব্যবসায়ী।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, শাহারুজ্জামানের স্ত্রীসহ অন্যরা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ৬৩৭ জন ব্যক্তির কাছ থেকে এটিএম কার্ড সংগ্রহ করেন। পরে ওই সব কার্ডের হিসাবে ২০ হাজার থেকে ৯৫ হাজার টাকা জমা দেওয়া হয়। এ টাকা জমা দিতেন সায়মা। পরে কার্ড ব্যবহার করে টাকা তুলতেন শাহারুজ্জামানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আল আমিন। লেনদেন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের তথ্যসংবলিত যে ইলেকট্রনিক জার্নাল তৈরি হতো, সেটি যাতে ব্যাংকের কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে জমা না হয়, সে ব্যবস্থা করতেন শাহারুজ্জামান। ব্যাংকের ব্যবস্থায় সফল লেনদেনকে অসফল লেনদেন করে দিতেন তিনি। তখন আবার তাঁর সহযোগীরা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিতেন যে বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের সময় টাকা কেটে নেওয়া হলেও তিনি টাকা বুঝে পাননি। তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আবার ওই হিসাবে টাকা সমন্বয় করে দিতেন।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, শাহারুজ্জামানের অন্যতম সহযোগী হলেন আসাদুজ্জামান ওরফে আসাদ। তিনি ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম বিসমিল্লাহ বিডি এন্টারপ্রাইজ। তিনি নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলের ১২৯ জনের ব্যাংক হিসাব খুলে দেন। পরে তাঁদের এটিএম কার্ড ও পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করে তা শাহারুজ্জামানের কাছে তুলে দেন। অপরদিকে সেলিম রেজা সিদ্ধিরগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ৯৭ জন পোশাককর্মীকে দিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলান। পরে তাঁদের এটিএম কার্ড ও পাসওয়ার্ড নম্বর তুলে দেন শাহারুজ্জামানের কাছে। আর ব্যবসায়ী মালেক ১৭৬ জন দরিদ্র মানুষের ব্যাংক হিসাব খুলিয়ে তাঁদের এটিএম কার্ড ও পাসওয়ার্ড সংগ্রহ করেন।
কার্ড নেওয়ার সময় তাঁর মালিককে বলা হতো, এ কার্ডের মাধ্যমে বিদেশ থেকে টানা আনলে সরকার প্রতি লাখ টাকার বিপরীতে তিন হাজার টাকা দেবে। সেখান থেকে এক হাজার টাকা করে তাঁদের দেওয়া হবে।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, শাহারুজ্জামান ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩৬৩টি লেনদেন করিয়ে আড়াই কোটি টাকা তুলে নেন। সবচেয়ে বেশি ৫২ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলের একটি বুথ থেকে। ওই বুথে সর্বোচ্চ ২৮৩ বার লেনদেন হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আসাদুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের ঘটনা জানাজানির পরপরই শাহারুজ্জামান দেশ ত্যাগ করেন।