আদালতে দেওয়া র্যাবের ১০টি অগ্রগতি প্রতিবেদনে ঘুরেফিরে একই ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় ১১ বছর আগে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি। সেদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (প্রয়াত) বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। খুনের দুই দিন পর পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহামুদ খন্দকারও বলেছিলেন, তদন্তের ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এখন ১১ বছরের মাথায় তদন্ত সংস্থা র্যাব বলছে, যত দ্রুত সম্ভব আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।
আদালতে জমা দেওয়া র্যাবের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষকে শনাক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসেস (আইএফএস) ল্যাবে ডিএনএ পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে ছবি প্রস্তুতির চেষ্টা চলছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএ ল্যাবের ফলাফল জেনেছে র্যাব। তবে অজ্ঞাতপরিচয় দুজনের ডিএনএ থেকে ছবি তৈরির সন্তোষজনক ফল আসেনি।
সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সাংবাদিক সাগর-রুনি খুনের মামলা তদন্ত করছে র্যাব। ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামত থেকে দুজনের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সন্দেহভাজন খুনি শনাক্তের কাজ চলছে।খন্দকার আল মঈন, র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার
মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৪ সালের পর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পক্ষ থেকে মামলার অগ্রগতি নিয়ে ঘুরেফিরে প্রায় একই ধরনের তথ্য আদালতকে দেওয়া হচ্ছে।
র্যাবের ১০টি অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি লিখিতভাবে র্যাব আদালতকে জানায়, সাগর-রুনির বাসা থেকে জব্দ করা আলামতের ডিএনএ পর্যালোচনায় অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষের উপস্থিতি মিলেছে। ২০১৭ সালের আরেকটি অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন থানায় সিঁধেল চুরিসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কেউ সাগর-রুনি হত্যায় জড়িত কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ফৌজদারি আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, র্যাব ১১ বছরেও এই হত্যার কূলকিনারা করতে পারল না, এটি হতাশার। ২০১৯ সালে হাইকোর্টও বলেছিলেন, দীর্ঘ সময়েও অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে না পারাটা নিঃসন্দেহে হতাশার।
সন্তানের বিচার দেখে যেতে পারেননি রুনির মা নূরণ নাহার মির্জা। গত বছর তিনি মারা গেছেন। আর সাগরের ৭৩ বছর বয়সী মা সালেহা মনিরও অসুস্থ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সাংবাদিক সাগর-রুনি খুনের মামলা তদন্ত করছে র্যাব। ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামত থেকে দুজনের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সন্দেহভাজন খুনি শনাক্তের কাজ চলছে।
তদন্তের বিলম্বের কারণ সম্পর্কে খন্দকার আল মঈন বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে যাতে কোনো বিতর্ক না হয়, সে জন্য সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ মামলার সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ধার্য ছিল গত ৪ জানুয়ারি। সেদিন র্যাব প্রতিবেদন জমা না দেওয়ায় আগামী ৫ মার্চ নতুন তারিখ ধার্য করেছেন ঢাকার সিএমএম আদালত। এ নিয়ে র্যাবকে ৯৫ বার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় দিলেন আদালত।
পুলিশের সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, র্যাব ঘুরেফিরে একই ধরনের তথ্য বলতে থাকলে, কোনো অগ্রগতি না থাকলে আদালত তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত তদন্ত ও বিচারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি খুন হন এই সাংবাদিক দম্পতি। ঘটনার সময় বাসায় ছিল তাঁদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ। সাগর মাছরাঙা টিভিতে আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন।
ঘুরেফিরে র্যাবের দুই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার কথা শুনতে শুনতে হতাশ সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা মনির। গত মঙ্গলবার পুরান ঢাকার নবাবপুরের বাসায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে র্যাবের মুখে শুনছি, খুনের স্থানের আলামত থেকে অজ্ঞাতপরিচয় দুজনের ডিএনএ মিলেছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, অজ্ঞাতপরিচয় সেই দুই ব্যক্তি কারা, তাদের নাম কী, কীভাবে খুন করা হলো—আমি সবকিছু জানতে চাই।’
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, মামলায় এ পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে দুজন জামিনে আছেন। বাকি ছয়জন কারাগারে। এখন পর্যন্ত ছয় কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন র্যাবের চার কর্মকর্তা।
বারবার তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন তদন্তের সাফল্যে প্রধান অন্তরায় উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে যাঁরা খুনের তদন্ত করেন, তাঁরা চুরি, ডাকাতি, নারী নির্যাতন ইত্যাদি মামলার তদন্ত করেন না। অর্থাৎ যাঁরা খুনের মামলার তদন্ত করবেন, তাঁরা অন্য অপরাধের তদন্ত করবেন না। এটা যত দিন না হবে, তত দিন তদন্ত কর্মকর্তার ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থেকে যাবে।