রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পিএসসির দুই উপপরিচালক হলেন মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম। সহকারী পরিচালক হলেন মো. আলমগীর কবির। এই তিনজনের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিবেদনের জন্য তিন বছর পদোন্নতি আটকে ছিল। তাঁদের মধ্যে দুজনের কোচিং ব্যবসা আছে। বেশি বেশি তদবির করার অভিযোগে তিনজনের একজনকে ঢাকা থেকে শাস্তিস্বরূপ বদলিও করা হয়। এ ছাড়া কর্মচারী মো. খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপরাধে ফৌজদারি ও বিভাগীয় মামলা হলেও অভিযোগ থেকে নাম কাটিয়ে আদালতের আদেশ নিয়ে আবার ফিরেছেন পিএসসিতে। আর সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী তো নিয়োগের সময় ঠিকানা জালিয়াতি করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে চাকরিও হারিয়েছেন তিনি। পিএসসির নথি ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির দুজনই চাকরির প্রস্তুতির কোচিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। বিষয়টি পিএসসির অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীই জানেন। ঢাকার মালিবাগের জ্যোতি কমার্শিয়াল চাকরির কোচিং সেন্টারের পরিচালক আবু জাফর। কোচিং সেন্টারটি তাঁর স্ত্রী জ্যোতির নামে। পিএসসির প্রশাসন শাখা থেকে জানা গেছে, কয়েক বছর পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত ছিলেন আবু জাফর। তিনি কোচিং সেন্টারে যুক্ত আর নানা নেতিবাচক আলোচনায় ছিলেন বলে তিন বছর তাঁর পদোন্নতি আটকে ছিল। গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেতিবাচক আসার কারণে পদোন্নতি আটকে ছিল বলে জানায় পিএসসির প্রশাসন শাখা।
এ ছাড়া মো. আলমগীর কবিরের কোচিং সেন্টার আছে ঢাকার মিরপুরে। পিএসসির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আলমগীর কবির আগে আজিমপুরে থাকতেন। কোচিং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মিরপুরে বাসা নেন। পিএসসিতে থাকার পরও এমন কোচিং সেন্টারে তাঁরা থাকলেও এ জন্য সরাসরি তাঁদের কোনো জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই দুজনের চাকরির প্রস্তুতির কোচিং ব্যবসা আছে, তা এবারে অভিযোগ আসার পর জানতে পেরেছি। আগে জানতে পারলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
পিএসসির ঢাকা অফিসে কর্মরত ছিলেন সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বিভিন্ন নিয়োগের বিষয়ে পিএসসি সদস্যদের কাছে নিয়মিত তদবির করতেন বলে অভিযোগ আছে। কোনো কোনো সদস্য তাঁর বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেন। এরই একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁকে এই অভিযোগে মৌখিকভাবে সতর্কও করা হয়। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় এ বছরের শুরুতে তাঁকে সিলেট আঞ্চলিক অফিসে বদলি করা হয়।
২০১২ সালে ৩৩তম বিসিএসের সময় কর্মচারী মো. খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানায় মামলা করা হয় এবং তাঁকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ওই সময় র্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। একই সময় তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও করা হয়। পিএসসির এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক দৌড়ঝাঁপ করে খলিলুর মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে সফল হন। পরে ২০২২ সালের মার্চে মামলা ও বিভাগীয় মামলায় যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। এই সাময়িক বরখাস্তের সময়ে তিনি বকেয়া বেতন–ভাতাও ফেরত পান। বর্তমানে তিনি ডেসপাস রাইডার পদে আছেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী পিএসসিতে চাকরি নিয়েছিলেন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে। এ ছাড়া ২০১৪ সালে নন-ক্যাডারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি থেকে তাঁকে বরখাস্ত করেছিল পিএসসি।
পিএসসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নন-ক্যাডারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদের লিখিত পরীক্ষা ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই পরীক্ষায় এক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে হলের বাইরে থেকে অবৈধভাবে সরবরাহ করা সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরসহ চারটি লিখিত উত্তরপত্র হাতেনাতে ধরা হয়। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ আইনের ধারায় মামলা করা হয়। ওই মামলার তদন্তে সৈয়দ আবেদ আলীর সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য-প্রমাণ মেলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। সৈয়দ আবেদ আলী বিরুদ্ধে বহু বেআইনি কর্মের দুর্নাম আছে। তিনি অভ্যাসগত অপকর্মে জড়িত বলেও পিএসসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সৈয়দ আবেদ আলীর গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার হলেও পিএসসিতে চাকরি নেওয়ার সময় স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে সিরাজগঞ্জ উল্লেখ করেছিলেন। এ ব্যাপারে পিএসসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাকরি থেকে বরখাস্তের চিঠি সৈয়দ আবেদ আলীর স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়। সৈয়দ আবেদ আলী ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পিএসসিতে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় তিনি স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের শ্রীফলতলা গ্রামে। বাবা সৈয়দ আবদুর রহমান। এই ঠিকানা উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয়ের গাড়িচালক পদের সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।
২০১৪ সালের ২২ এপ্রিলে নন-ক্যাডার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদে লিখিত পরীক্ষায় লিখিত উত্তরপত্র সরবরাহ করার অভিযোগে সৈয়দ আবেদ আলীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী তাঁর স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়। ডাক বিভাগ সৈয়দ আবেদ আলীর স্থায়ী ঠিকানায় চিঠি গ্রহণের জন্য কাউকে না পেয়ে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণীটি পিএসসিতে ফেরত পাঠায়। একইভাবে সাময়িক বরখাস্তের আদেশটিও ফেরত আসে।
অভিযুক্ত কর্মচারীর স্থায়ী ঠিকানাটির সঠিকতা যাচাই করে ২০১৪ সালের ১৮ নভেম্বরে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক পিএসসিকে জানান, তাঁর স্থায়ী ঠিকানাটি সঠিক নয় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার তালিকায় সৈয়দ আবেদ আলী বা তাঁর পূর্বপুরুষদের কেউ তালিকাভুক্ত নন। অর্থাৎ সৈয়দ আবেদ আলী ভুয়া স্থায়ী ঠিকানায় চাকরি নিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অপর একটি বিভাগীয় মামলা চলছে।