নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অন্যতম শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিবসহ (৩৪) তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র্যাব। গতকাল সোমবার রাতে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় তল্লাশিচৌকি বসিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার অন্য দুজন হলেন জাকারিয়া হোসাইন (২৯), আহাদুল ইসলাম মজুমদার ওরফে সিফাত ওরফে মামিদ (২২)। তাঁদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনের মধ্যে মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব ২০১৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরে দেশে ফিরে জামাতুল আনসারে যোগ দেন। সংগঠনটির অর্থ শাখার প্রধান হন। অর্থ সংগ্রহ এবং বিতরণ তাঁর হাত দিয়েই হতো।
র্যাব বলছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানিয়েছেন, পাহাড়ি এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান এবং তৎপরতার কারণে কৌশল পরিবর্তন করেছে সংগঠনটি। এখন থেকে তারা টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে অবস্থান করে সংগঠন পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে। নিজেদের আত্মগোপন করতেই তারা এই কৌশল নিয়েছে।
গ্রেপ্তার তিনজনসহ কয়েকজন গাজীপুর হয়ে টাঙ্গাইলের মধুপুরের দিকে যাচ্ছিলেন, এমন সংবাদের ভিত্তিতেই চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল।
তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানিয়েছেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী কেএনএফের (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) সঙ্গে চুক্তি করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে আশ্রয়, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পাশাপাশি জামাতুল আনসারকে অস্ত্র ও ‘রশদ’ সরবরাহ করত কেএনএফ।
খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানের ফলে পাহাড়কে নিরাপদ না মনে করায় আমিরের নির্দেশে জঙ্গিরা পাহাড় থেকে পালিয়ে সমতলের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে যায়। এরপর আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এখন তারা সংগঠনের আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদের নির্দেশে টাঙ্গাইলের মধুপুরের ঘন জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে সংগঠন পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে।
র্যাব সূত্র জানায়, গত বছরের (২০২২) ২৩ আগস্ট কুমিল্লা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আট তরুণ নিখোঁজের সূত্র ধরে র্যাবের গোয়েন্দা শাখা এবং অন্যান্য ব্যাটালিয়ন গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। একপর্যায়ে নতুন এই জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসারের খোঁজ পাওয়া যায়।
এই সংগঠনের ৫৫ জন সদস্য কেএনএফের ছত্রচ্ছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে বলে জানা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে গত বছরের ৩ অক্টোবর থেকে র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। সেই অভিযান এখনো চলছে।
জানা যায়, কেএনএফের সদস্যরা মূলত বম জাতিগোষ্ঠীর। পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ আস্তানা গড়ে তোলার জন্য কেএনএফের সঙ্গে যোগাযোগ করে জামাতুল আনসার। অর্থের বিনিময়ে জামাতুল আনসার ২০২১ সালে কেএনএফের সঙ্গে চুক্তি করে। প্রশিক্ষণ এবং পাহাড়ে অবস্থান করে নিজেদের আড়াল করতে জামাতুল আনসার এই কৌশল নিয়েছিল।
গ্রেপ্তার তিনজন সম্পর্কে যা জানাল র্যাব
মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব জামাতুল আনসারের অন্যতম শুরা সদস্য ও অর্থ শাখার প্রধান। তিনি ২০১৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে থাকার সময় জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। ২০১৬ সালে দেশে ফিরে আনসার আল ইসলামে যোগদান করেন। এর পাশাপাশি গার্মেন্টস পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন। শুরু থেকেই তিনি সংগঠনের অর্থ সংগ্রহ ও সরবরাহের দায়িত্বে আছেন। দেশ ও দেশের বাইরে থাকা সংগঠনের অর্থ তাঁর কাছেই থাকত।
জাকারিয়া ২০০৮ সালে স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে হিফজ শেষ করে ফরিদপুরে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০২১ সালে অর্থ শাখার প্রধান মোশারফ হোসেনের মাধ্যমে তিনি সংগঠনে যোগ দেন। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যাওয়ার কথা বলে তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। ২০২২ সালের প্রথম দিকে তিনি রাকিবের মাধ্যমে বান্দরবানের থানচি ও বাকলাইপাড়া হয়ে কেএনএফের প্রশক্ষিণ ক্যাম্পে আসেন। তিনি পাহাড়ে এসে অস্ত্র চালনাসহ সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন।
আহাদুল কুমিল্লার একটি কলেজে অনার্স ৪র্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৮ সালে এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে সংগঠনের আমির মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। সংগঠনের আমির মাহমুদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি সংগঠনে যোগ দেন। তিনি ২০২১ সালে শুরুতে ঘর ছাড়েন।
পরে তিনি পাহাড়ে কেএনএফের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরিসহ বিভিন্ন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরুর জাকারিয়া এবং আহাদুল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে সমতলে এসে আত্মগোপন করেন।