৯ মাস আগে রাজধানীর বনানী এলাকার একটি অফিসের জানালার গ্রিল কেটে তিন লাখ টাকাসহ সাত লাখ টাকা মূল্যের মালামাল চুরি হয়। এ ঘটনায় বনানী থানায় চুরির মামলা হলেও চুরি হয়ে যাওয়া মালামাল উদ্ধার হয়নি। এমনকি এই চুরির সঙ্গে জড়িত কেউ ধরা পড়েনি। চুরির ছয় মাসের মাথায় গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বনানী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মনসুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অনেক চেষ্টা করেও বনানীর অফিস থেকে মালামাল চুরির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কাউকে শনাক্ত করতে পারেননি। চুরির সময় চোরেরা মুখোশ পরে এসেছিল। তাদের চেহারা শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
কেবল বনানী থানার এই মামলাই নয়, রাজধানীতে সংঘটিত চুরির ৩০৪টি মামলায় গত বছর ঢাকার সিএমএম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ। এর মধ্যে ২০২১ সালের ২০৯টি ও ২০২২ সালের ৯৫টি মামলা রয়েছে।
পুলিশ ও ঢাকার সিএমএম আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত বছর ঢাকা মহানগরে চুরির মামলা হয়েছে ৮৪৬টি। এসব চুরির মধ্যে বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে বাসা ও অফিসে। সংঘবদ্ধ চোরের দল বাসা কিংবা অফিসের তালা ভেঙে, গ্রিল কেটে টাকা, স্বর্ণালংকারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মালামাল চুরি করে। এর বাইরে গৃহকর্মীর চুরি, বাসসহ অন্যান্য গণপরিবহনে যাত্রীর মালামাল চুরির ঘটনায়ও মামলা হয়েছে। তবে চুরির অনেক মামলায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে না পারায় সংঘবদ্ধ চোরের দল অধরাই থেকে যায়।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগরের অনেক চুরির মামলায় চোরদের চিহ্নিত করা কিংবা গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় না। মামলায় যদি আসামি শনাক্ত না করা যায়, তখন তো সন্দেহভাজন কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া সম্ভব হয় না। চোর শনাক্ত না হলে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হয়।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জে মারুফ কমপ্লেক্সে ভিশন এম্পোরিয়ামের শোরুমে ঢুকে ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ১২টি টিভি, ২টি গ্যাস স্টোভসহ ৫ লাখ টাকার মালামাল চুরি হয়। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা হলেও কোনো চোর কিংবা মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ।
মামলার বাদী ও ভিশন এম্পোরিয়ামের দয়াগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মো. ঐশিক উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চোরের দল আমাদের শোরুমের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি ক্যামেরা) ভেঙে সেদিন চুরি করেছিল। কিন্তু পুলিশ কাউকে ধরতে পারেনি। আমরা মালামালও ফেরত পাইনি।’
এ ব্যাপারে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাযহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চুরির অনেক ঘটনায় পুলিশ চোরকে ধরতে পারে না, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে প্রতিটি ঘটনায় চোর ধরার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়ে থাকে। ভিশন এম্পোরিয়ামের চুরির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।
পুলিশের দেওয়া ২৫টি চুরির মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনায় জড়িত প্রকৃত আসামি, চোরাই টাকা ও স্বর্ণালংকার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই মামলাটি দীর্ঘায়িত না করার পক্ষে মতামত দেন তাঁরা। তবে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চুরির ঘটনার পরপরই যদি চোর শনাক্ত না হয়, পরে আর হয় না। এ ধরনের মামলা অপেক্ষাকৃত গুরুত্ব কম পায় এবং ওই সব ঘটনায় ফলোআপ না থাকায় শেষ পর্যন্ত আর চোরের দল শনাক্ত হয় না।
রাজধানীর ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ফারুক উদ্দিন ২০২১ সালের জুলাই মাসে ঈদুল আজহা উদ্যাপন করতে সাভারে যান। ঈদ শেষে বাসায় ফিরে ফারুক দেখেন, সংঘবদ্ধ চোরের দল বাসা থেকে প্রায় ১১ ভরি সোনার গয়না, নগদ টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী চুরি করেছে। এ ঘটনায় ভাটারা থানায় মামলা হয়। কিন্তু ঘটনায় জড়িত কোনো চোরকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ মামলাটি তদন্ত করলেও কাউকে শনাক্ত না করতে পেরে গত বছরের ৩০ আগস্ট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির এসআই মানিক কুমার শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, সব ধরনের চেষ্টা করেও বাসায় চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হয়েছে।
২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর জাকির হোসেন নামের এক ব্যবসায়ীর বাসার দরজার তালা ভেঙে চোর ছয় লাখ টাকাসহ এক ভরি স্বর্ণ চুরি করে। এ ঘটনায় মামলা হয়। তবে কোনো চোর ধরতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। মামলার বাদী জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাসায় রেখেছিলাম। সেই টাকা চুরি হয়। পুলিশকে আমি বাসার সিসিটিভির ফুটেজ দিয়েছিলাম। তাতে দুই চোরকে দেখা গেছে। পুলিশ চাইলে তাঁদের ধরতে পারত, কিন্তু ধরেনি।’
চোর ধরতে না পারার বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগরে মানুষের বাসা থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার চুরি হয়ে যাবে, কিন্তু চোর ধরা পড়বে না, এটা তো দুঃখজনক ঘটনা। যাঁর মালামাল চুরি হয়ে যায়, তিনি যদি দেখেন পুলিশ চোর ধরতে পারেনি, তখন তাঁর মধ্যে হতাশা কাজ করে।
পুলিশের সাবেক এই মহাপরিদর্শক মনে করেন, প্রতিটি থানায় এখন তদন্ত করার জন্য আলাদা একজন পরিদর্শক সার্বক্ষণিক কাজ করে থাকেন। তারপরও ঢাকা মহানগরে এতসংখ্যক মামলায় চোর না ধরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার চিত্র চরম হতাশাজনক। এ অবস্থা বদলাতে হবে। তা না হলে পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা কমবে।