বাংলাদেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ওয়েবসাইট রিং আইডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শরীফুল ইসলাম, তাঁর ভাই সাইফুল ইসলাম ও স্ত্রী আইরিন ইসলামের বিরুদ্ধে ৩৭ কোটি টাকা অর্থ পাচারের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সিআইডি বলছে, প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেন রিং আইডির কর্তাব্যক্তিরা। রিং আইডির হিসাব থেকে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে স্থানান্তর করা হয়।
প্রায় এক বছর অনুসন্ধান শেষে ৪ আগস্ট শরীফুল, সাইফুল ও আইরিনের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় অর্থ পাচারের মামলা করেছে সিআইডি। গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার আসামিদের মধ্যে রিং আইডির মালিক শরীফুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী আইরিন ইসলাম পলাতক।
মামলায় সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) আল ইমাম বলেছেন, রিং আইডির পাঁচটি ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩৭৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৩০২ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই অর্থের মধ্যে ৩৭ কোটি টাকা পাচার ও আত্মসাৎ করেছেন রিং আইডির মালিকেরা।
টেলিযোগাযোগ খাতে ভিশনটেল ও ক্লাউডটেল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা করে আসছিলেন শরীফুল ও আইরিন ইসলাম দম্পতি। ২০১৪ সালে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৯৬ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ এনেছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা (বিটিআরসি)। এ মামলায় ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাঁদের। পরে ওই বছরই রিং আইডি চালু করেন কম্পিউটার সায়েন্সে লেখাপড়া করা শরীফুল। নিজে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়ে স্ত্রীকে করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আর ভাই সাইফুল ইসলামকে করেন পরিচালক। রিং আইডির গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের খবর প্রকাশের পর গত বছর সাইফুলকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, রিং আইডির ব্যবসার আড়ালে আসামিরা অবৈধ মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) করে আসছিলেন। অল্প সময়ে বেশি আয় ও বেশি কমিশন দেওয়ার ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিতেন তাঁরা। রিং আইডির দৃশ্যমান কোনো আয় ছিল না। তাঁরা অল্পসংখ্যক গ্রাহকদের কিছু টাকা ফেরত দিলেও তা ফেরত দিয়েছে গ্রাহকদের টাকা থেকে। পরিশোধের এ পদ্ধতি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা পঞ্জি স্কিমের মতো। এমএলএম ব্যবসা পরিচালনায় নিবন্ধন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তাঁরা নেয়নি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, রিং আইডি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া গেছে। একটি প্রতিষ্ঠানের নাম রিং আইডি বিডি লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানটি যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নেয় ২০১৫ সালে। অপর প্রতিষ্ঠানটির নাম রিং আইডি ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধন নেয় ২০২১ সালের ৩০ জুন। দুই প্রতিষ্ঠানের পাঁচটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেগুলোতে ৩৭৭ কোটি ৪৯ লাখ টাকা জমা হয়। এর মধ্যে ৩০২ কোটি ২৬ লাখ টাকা তুলে নেওয়া হয়।
মামলার এজাহারের তথ্য বলছে, রিং আইডি বিডি লিমিটেড ও রিং আইডি ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড থেকে শান্তা সিকিউরিটিজ, আরএনআই সিকিউরিটিজ ও ভার্টেক্স স্টক অ্যান্ড সিকিউরিটিজের মাধ্যমে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হয়। এর বাইরে আরও চার কোটি টাকা তাঁদেরই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।
সিআইডি বলছে, রিং আইডি ‘কমিউনিটি জব’ নামে প্রতারণার একটি বিশেষ ফাঁদ তৈরি করে। গ্রাহকদের তাঁরা সিলভার আইডি, গোল্ড আইডি, প্রবাসী গোল্ড আইডি ও প্রবাসী প্লাটিনাম আইডি খুলতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এসব আইডি খুলতে গ্রাহকদের প্রতিষ্ঠানটিতে ১২ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হতো। পরিচয়পত্রধারীরা ভিপিএনের মাধ্যমে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখতেন, তার বিনিময়ে লাভ পেতেন। বিদেশি যে বিজ্ঞাপনগুলো গ্রাহকেরা দেখতেন, তার জন্য পাওয়া টাকা আর দেশে ঢোকেনি।
সিআইডি কর্মকর্তা আল ইমাম বলেন, গ্রাহকেরা বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখায় গুগল অ্যাডসেন্স থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। তবে রিং আইডির বাংলাদেশের ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা জমা থাকার তথ্য পাওয়া যায়নি। আসামিরা বৈদেশিক মুদ্রা দেশে নয়, অবৈধভাবে বিদেশের কোনো ব্যাংক হিসাবে অর্থ পাচার করেছেন।