ভারতের কারাগারে বন্দী সাবেক পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানা

শেখ সোহেল রানা
ফাইল ছবি

ঢাকার বনানী থানার সাবেক পরিদর্শক (তদন্ত) ও ই অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক শেখ সোহেল রানা ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে সেখানকার একটি কারাগারে বন্দী আছেন। সম্প্রতি হাইকোর্টে দেওয়া এক প্রতিবেদনে পুলিশ সদর দপ্তর এই তথ্য জানিয়েছে।

অন্য দেশ থেকে আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি)। শনিবার রাতে যোগাযোগ করা হলে এনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি হাইকোর্ট সোহেল রানার বিরুদ্ধে হওয়া একটি মামলায় তাঁর অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে ভারতের দিল্লি এনসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ সদর দপ্তর জানতে পারে, সোহেল রানা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আলীপুরের কেন্দ্রীয় কারোগারে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে হওয়া মামলায় সেখানকার একটি আদালতে বিচার চলছে।

পুলিশ কর্তৃপক্ষ বলছে, ঢাকায় সোহেল রানার বিরুদ্ধে মাট ৯টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার তদন্তে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে অনা জরুরি। পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু গত ১৫ মাসেও ফেরত আনা যায়নি।

শুরুতে পুলিশ তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তৎপর ছিল। এ নিয়ে গত বছরের মে মাস পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তর ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে। এখন সবই থেমে আছে। পুলিশের তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কিছু বলতে পারছেন না।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ‘প্রতারণা’র বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সোহেল রানা ভারতে পালিয়ে যান। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে গ্রেপ্তার হন। এরপর থেকে তিনি সেখানকার কারাগারে আছেন। প্রতারণার ঘটনার পর সোহেল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তিনি নেপথ্যে থেকে ই-অরেঞ্জ নামের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে গত বছর মে মাস পর্যন্ত পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি ভারতের এনসিবিকে আটবার চিঠি দিয়েছিল। ভারত এর মধ্যে দুবার চিঠির জবাবও দেয়। তারা জানিয়েছিল, সোহেল রানার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের দায়ে মামলার বিচার চলছে। এর বাইরে অন্য কোনো তথ্য তারা দেয়নি।

২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তখনকার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে।

ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে (আনঅফিশিয়ালি) কথাও হয়েছে। শিগগিরই অফিশিয়ালি কথা হবে। ভারতের সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে, তাই তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে খুব একটা সমস্যা হবে না।

ওই দিন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামও সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বলেছিলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিএসএফকে চিঠি দিয়ে সোহেল রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অনেক সময় এটি করা হয়। আমরা তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। যদি এ মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হয়, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁকে ফেরত আনার চেষ্টা করব।’

আইন বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, সোহেল রানার বিরুদ্ধে যেহেতু দেশে ফৌজদারি মামলা আছে তাই তাঁকে ফিরিয়ে আনা জটিল কিছু হবে না। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের আইনে অনুপ্রবেশ একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধ। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার করে বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ফিরিয়ে এনে বিচার করার সুযোগ আছে।

সোহেল রানার সম্পদ

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর শাহজাদপুরে একটি, গুলশান মডেল টাউনে একটি, নিকেতনে দুটি ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ই–ব্লকে একটি ফ্ল্যাট আছে সোহেল রানার। গুলশানে একটি বাণিজ্যিক ভবনে ৯ কোটি টাকায় স্পেস (জায়গা) কিনেছেন তিনি। এ ছাড়া বসুন্ধরা ও পূর্বাচলে সোহেল রানার দুটি প্লট এবং গুলশান ও উত্তরায় তিনটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে। ঢাকার বাইরে নিজ জেলা গোপালগঞ্জ এবং খাগড়াছড়িতে তিনি জমি কিনেছেন বলে জানা যায়।

সোহেল রানার এই বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ নিয়ে পুলিশ অনুসন্ধান করার কথা জানিয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা আর এগোয়নি। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের পাতায়ায় সুপারশপ, জমি ও ফ্ল্যাট; পর্তুগালের লিসবনে সুপারশপ, বার ও রেস্তোরাঁ; ফিলিপাইনের ম্যানিলায় বার এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে সোহেল রানার একটি বার ও ক্যাসিনো আছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, সোহেল রানা স্থলপথে ভারত হয়ে নেপালে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

সোহেল রানা বছর ছয়েক আগে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের পরিদর্শক হন। এর আগে দীর্ঘদিন গুলশান ও বাড্ডা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ছিলেন। গুলশান বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোহেল রানা ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গুলশান থানার এসআই থাকাকালে কূটনৈতিক এলাকার দায়িত্ব পালন করেন। তখন বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সোহেল রানা বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়েছেন বলেও তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

সোহেল রানা গুলশানের পর ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মালিবাগে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হলেও ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) ছিলেন সোহেল রানা। এরপর চার মাস পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটে ছিলেন। ২০২০ সালের ২৮ মে বনানী থানায় পরিদর্শকের (তদন্ত) দায়িত্ব পান। দেশ ছাড়ার আগে ওই পদেই ছিলেন তিনি।

মামলা

গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দেশের যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তার একটি ই-অরেঞ্জ। ২০২১ সালের ১৮ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা হয়। এরপর সোহেল রানার নাম আলোচনায় আসে। বর্তমানে সোহেল রানা, তাঁর কথিত স্ত্রী নাজনীন নাহার, বোন সোনিয়া মেহজাবিন ও ভগ্নিপতি মাশুকুর রহমানের নামে মোট ৯টি মামলা আছে। এসব মামলায় প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ, অর্থপাচারসহ (মানি লন্ডারিং) বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে। সোহেলের বোন সোনিয়া ও ভগ্নিপতি মাশুকুর এখন কারাগারে আর স্ত্রী নাজনীন নাহার পলাতক।

মামলাগুলো পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তদন্ত করছে। চারটি মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারণা করে গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোহেল রানা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি চারটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

সোহেল রানার বিরুদ্ধে হওয়া মানিলন্ডারিং আইনের মামলা তদন্ত করছেন সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ ছাদেক আলী। সোহেল রানাকে ফেরত আনার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এনসিবিকে চিঠি দিচ্ছেন। কিন্তু সোহলকে ফেরত আনার অগ্রগতি সম্পর্কে জানেন না। তবে মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে বলেন, সোহেলের ব্যাপারে তথ্য চেয়ে ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেই তথ্যও এসেছে। এখন পর্যন্ত সোহেল রানার বিরুদ্ধে ২৫০ কোটি টাকার অপরাধলব্ধ আয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই আদালতে এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

সোহেল রানার বিরুদ্ধে প্রতারণা করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অন্য চারটি মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এসব মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলে জানিয়েছেন ডিএমপির সংশ্লিষ্ট তদন্ত সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য, ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে শিগগিরই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।