আদালতের ফটকের সামনে থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আনসার আল ইসলামের ১০ জনের বেশি সদস্য অংশ নেন। তাঁরা আটটি মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে আসেন। দুটি ভাগে ভাগ হয়ে তাঁদের একটি দল আদালতে পুলিশের ওপর হামলা করে, আরেকটি দল আশপাশের কয়েকটি গলির ভেতরে মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ঘটনার পর ওই দুই সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিসহ অন্যরা এসব মোটরসাইকেলে পালিয়ে যান।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও তথ্যপ্রযুক্তি সহায়তায় প্রাপ্ত তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমনটা জানতে পেরেছেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার আশপাশের সিসি ক্যামেরায় ছয়জনকে দেখা গেছে, যাঁরা জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় সরাসরি অংশ নেন। আদালত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর জঙ্গিরা মোটরসাইকেলে করে রায়েরবাগ হয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় যান। সেখান থেকে নদীপথে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে তিন চাকার যানে করে মেঘনা সেতুর দিকে যান। এভাবে ভেঙে ভেঙে ভারত সীমান্ত এলাকার দিকে যান।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, হামলাকারী জঙ্গি দলটিকে প্রযোজনে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য একটি দল (ব্যাকআপ টিম) ছিল; যারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে আশপাশে অবস্থান করছিল। এমন একজনকে শনাক্ত করা গেছে, যার কাঁধে একটি ব্যাগ ছিল।
গত রোববার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ফটকে পুলিশকে মারধর ও চোখে স্প্রে নিক্ষেপ করে আনসার আল ইসলামের দুই সদস্যকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। ওই সময় ওই আসামিদের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি হলেন মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। তাঁরা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি হত্যা মামলার আসামি তাঁরা। এসব লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যা মামলার প্রধান আসামি আনসার আল ইসলামের নেতা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হক।
জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় করা মামলার তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। এ ছাড়া এই জঙ্গিদের ধরতে র্যাবের সব কটি ইউনিট ও পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটসহ (এটিইউ) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সংস্থাও কাজ করছে।
আদালত অঙ্গন থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁকেসহ কয়েকজন শনাক্ত করা হয়েছে বলে গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, এসব জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি আনসার আল ইসলামের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়া ও পুলিশের ওপর হামলায় ১০ থেকে ১২ জন ছিলেন। এসব জঙ্গি যাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছাড়তে না পারেন, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সীমান্তে সতর্ক আছে।
ঘটনার পর ওই এলাকা থেকে পুলিশ একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করে। পুলিশ বলছে, সেটা জঙ্গিদের ফেলে যাওয়া মোটরসাইকেল। এর মালিককে শনাক্ত করা গেছে বলে দাবি সিটিটিসির কর্মকর্তাদের। তাঁরা বলেন, হাসান আল মামুন নামের এক ব্যক্তি পুরান ঢাকার ঠিকানা ব্যবহার করে মোটরসাইকেলটি রেজিস্ট্রেশন করেন। পরে আশিকুজ্জামান নামের আরেক ব্যক্তি ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে সেটি চালাতেন। তাঁর মোটরসাইকেল জঙ্গিদের কাছে কীভাবে গেল, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
এদিকে মামলার ছায়া তদন্ত করছে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে এবং এক পুলিশকে হত্যা করে তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছিল আরেক নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি। পরে ওই ঘটনায় জড়িত ৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সেই মামলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন মাঠে নেমেছেন এটিইউর দুটি দল।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় আদালতের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা পুলিশের পাঁচ সদস্যকে গতকাল সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন সিএমএম আদালতের হাজতখানার কোর্ট ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান, হাজতখানার ইনচার্জ (উপপরিদর্শক) নাহিদুর রহমান ভূঁইয়া, উপপরিদর্শক মহিউদ্দিন ও কনস্টেবল শরিফ হাসান ও আবদুস সাত্তার।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের নেতা মেজর (বরখাস্ত) সৈয়দ জিয়াউল হকের পরিকল্পনায় ১৮ সহযোগী মিলে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁরা জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাস্থল এবং আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছেন। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা ২০ থেকে ২১ জনকে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে।
জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) মনজুর রহমান গতকাল এ তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন। কীভাবে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এতে কারও গাফিলতি ছিল কি না, তদন্ত কমিটিকে সেটা খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।