ইডেন মহিলা কলেজ
ইডেন মহিলা কলেজ

ইডেনে ছাত্রলীগই ‘সব’, চোখ ‘বন্ধ’ থাকে কর্তৃপক্ষের

‘ইডেন কলেজের প্রেসিডেন্টের ওপরে আর কেউ নাই’—কয়েক দিন আগে ছড়িয়ে পড়া এক অডিওতে এ কথা বলতে শোনা গিয়েছিল তামান্না জেসমিন ওরফে রীভাকে, যিনি ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিষয়টি আসলে তেমনই। ইডেন কলেজে ছাত্রলীগই সব। কলেজের ছাত্রীনিবাসের বেশির ভাগ কক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের হাতে। তাঁরা সেখানে টাকা নিয়ে ছাত্রীদের ওঠান। দলীয় কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য করেন। কেউ কোনো কারণে কর্মসূচিতে যেতে না পারলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।

এমনই এক নির্যাতনের ঘটনা গত শুক্রবার সামনে আসে ছড়িয়ে পড়া অডিও রেকর্ডের মাধ্যমে। রেকর্ডে শোনা যায়, কলেজটির রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের ২০২ নম্বর কক্ষে দুই ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন এবং হুমকি দিচ্ছেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন।

গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর তামান্না জেসমিন ছাত্রলীগের কাছে দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, চার দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার সেই দুই ছাত্রীকে রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসের একটি কক্ষে প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে মানসিক নির্যাতন করেন তামান্না।

নির্যাতনের একপর্যায়ে কথামতো স্বীকারোক্তি না দিলে তামান্না দুই ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এতে দুই শিক্ষার্থী স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য হন। তামান্না দুই ছাত্রীকে বলতে বলছিলেন এই যে তাঁরা আগের ঘটনার অডিও রেকর্ড করেছেন আরেক ছাত্রলীগ নেত্রীর নির্দেশে।

খবর পেয়ে ছাত্রীনিবাসটির প্রশাসন ওই কক্ষে গিয়ে দুই শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করে। পরে শিক্ষকদের সামনে ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী ঘটনা খুলে বলেন। সেই বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ রয়েছে।

অধ্যক্ষের চোখে এসব ‘অপপ্রচার’

ইডেন কলেজে দুই শিক্ষার্থীকে দুই দফা মানসিক নির্যাতন ও হুমকির ঘটনা ঘটলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং ভুক্তভোগী দুই শিক্ষার্থীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

দুই শিক্ষার্থীকে মানসিক নির্যাতনের ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে যাওয়া হয় কলেজের অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্যের কার্যালয়ে। তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

পরে রাজিয়া বেগম ছাত্রীনিবাসে যাওয়া হয়। তবে সেখানে গিয়ে প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমাকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে কল করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

অবশ্য গতকাল বিকেলে অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য দুই ছাত্রীকে মানসিক নির্যাতন ও হুমকির ঘটনাকে অপপ্রচার বলে দাবি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও জানতে চাইছি, আসলে কেন এ ধরনের প্রচারণা হলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুটি ভিডিও একসঙ্গে জোড়া দিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। ঘটনা কী, সেটা আমাদেরও প্রশ্ন। এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর।’

অবশ্য একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ভুক্তভোগী ছাত্রী ছাত্রীনিবাসের প্রশাসনের কাছে ভীত অবস্থায় ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। ভিডিও দেখে ছাত্রীনিবাসের ছাত্রীরা জানাচ্ছেন, যে কক্ষে ভিডিও ধারণ করা হয়েছে, সেটি ছাত্রীনিবাস প্রশাসনের ব্যবহৃত একটি কক্ষ। ঘটনাস্থলে ছাত্রীটি যাঁকে ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করছিলেন, তিনি ছাত্রীনিবাসের প্রাধ্যক্ষ নারগিস রুমা।

ছাত্রীদের প্রশ্ন, এত কিছু সামনে আসার পরও অধ্যক্ষ কীভাবে ঘটনাটি অস্বীকার করতে পারেন। তিনি একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেননি।

ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে দুই দফা দুই ছাত্রীকে মানসিক নির্যাতন ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠলেও ছাত্রলীগ কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি। কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তা জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মুঠোফোনে গতকাল একাধিকবার কল করা হয়। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সোহান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা সত্য হলে তামান্না জেসমিনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দায়িত্বশীল ভূমিকা নেবেন বলে আশা করি।’

ছাত্রলীগই ‘সব’

তামান্না জেসমিন ইডেন কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীরা জানিয়েছেন, শুরু থেকেই এক যুগ ধরে তামান্না ছাত্রীনিবাসে থাকেন। এখন থাকেন কলেজের বঙ্গমাতা ছাত্রীনিবাসের ১১০৭ নম্বর কক্ষে।

সূত্র জানায়, কলেজটিতে ছাত্রলীগের দুটি মূল গ্রুপ রয়েছে। একটির নেতৃত্বে রয়েছেন তামান্না। অন্যটির নেতৃত্ব দেন সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানা। এর বাইরে আরও কিছু ছোট গ্রুপ রয়েছে। গতকাল কলেজ প্রাঙ্গণে ঢুকতেই দেখা যায়, চারদিকে অভিনন্দনের বড় বড় ব্যানার। কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতির ছবিসহ ব্যানারই বেশি।

কলেজে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের এই ধরনের হুমকি–ধমকি নিয়মিত ঘটনা। এবার শুধু অডিও ফাঁস হয়েছে বলে আলোচনায় এসেছে। প্রশাসন কখনোই এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ইডেন কলেজে ৩৫ হাজার ছাত্রীর বিপরীতে ছয়টি আবাসিক ছাত্রীনিবাসে আসন আছে ৩ হাজার ৩১০টি৷ বর্তমানে ছাত্রীনিবাসগুলোতে থাকছেন আট হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। আবাসন সুবিধার এ ঘাটতি এবং কলেজ ও ছাত্রীনিবাস প্রশাসনের নীরবতার সুযোগে ঐতিহ্যবাহী এ কলেজে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ছাত্রীনিবাসে সিট পান না। তবে কম খরচ এবং নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার কারণে শিক্ষার্থীরা ছাত্রীনিবাসে উঠতে চান। ছাত্রলীগের নেত্রীরাই প্রথম বর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের ছাত্রীনিবাসে ওঠানো শুরু করেন। এ জন্য দিতে হয় এককালীন ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যাওয়া ও নেত্রীদের কথামতো কাজ করা তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক। কেউ কর্মসূচিতে না গিয়ে ছাত্রীনিবাসে থাকতে চাইলে টাকা দিতে হয়। শিক্ষার্থী নন, এমন কেউ কেউ টাকা দিয়ে ছাত্রীনিবাসে থাকেন।

সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের গ্রুপগুলো মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ে। বিগত তিন বছরে এমন অন্তত চারটি ঘটনার খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। একটি ঘটনায়ও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ।

হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছাত্রীনিবাসের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ছাত্রীনিবাসে এক হাজারের মতো আসন রয়েছে। প্রতিটি তলায় দু-একটি ছাড়া সব কটিই ছাত্রলীগনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক কক্ষ। প্রতিটি কক্ষে চারটি করে বেড (বিছানা) আছে। কিন্তু থাকছেন ১০ থেকে ১৫ জন করে।

সিট–বাণিজ্য ও নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিনের বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। সিট–বাণিজ্যের অভিযোগ মানতে নারাজ কলেজের অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য৷ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিট দেয় কর্তৃপক্ষ। এখানে বাণিজ্যের কথাটা আসছে কোত্থেকে?’

অবশ্য কয়েক দিন আগে ছড়িয়ে পড়া অডিও রেকর্ডে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতিকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি যদি একটা সিট না দিই, ২০২ থেকে তোদের কোন বাপ সিট দেবে? ম্যাডামরা দেবে? ক্ষমতা আছে ম্যাডামদের?’

‘প্রশাসন বরাবরই চুপ থেকেছে’

ছাত্রলীগের সিট–বাণিজ্য এবং ছাত্রীনিবাসের সমস্যা নিয়ে ইডেন কলেজ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয় না বলে উল্লেখ করেন কলেজের ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সায়মা আফরোজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন ছাত্রলীগের ব্যাপারে বরাবরই চুপ থেকেছে। কলেজে কোনো সমস্যা হলে তা নিয়ে কথা বলতেও নিরুৎসাহিত করা হয়। কারণ, এতে নাকি কলেজের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।