মিরপুরে ফাস্ট ফুড দোকানি হত্যা

সমাবেশে না যাওয়ায় হাফিজুলের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন যুবলীগ কর্মীরা, অভিযোগ স্বজনদের

ঢাকার মিরপুর–১০ নম্বরে মারধরে নিহত ফাস্ট ফুড বিক্রেতা হাফিজুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার মিরপুরে ফাস্ট ফুড বিক্রেতা হাফিজুল ইসলাম (২৭) হত্যাকাণ্ডে যুবলীগের এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার আসামি আরও দুজন যুবলীগ নেতা–কর্মী পলাতক। স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন, যুবলীগের সমাবেশে যেতে না চাওয়ায় হাফিজুলের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন সংগঠনটির ওই নেতা–কর্মীরা। সেই ক্ষোভ থেকেই তাঁরা হাফিজুলকে মারধর করেছিলেন।

এই হত্যা মামলার বাদী ও হাফিজুলের ছোট ভাই সজীব মিয়া আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার আসামি আসাদুজ্জামান ওরফে চয়ন ছাড়াও আমিনুল ইসলামসহ কয়েকজন গত রোববার বিকেলে মিরপুর–১০ নম্বরে ফল পট্টির পাশে তাঁর ভাইয়ের দোকানে যান। তখন তাঁরা তাঁকে পল্লবীতে ১৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সোমবারের সমাবেশে যোগ দিতে শাসিয়ে যান। তাঁর ভাই বলেছিলেন, তিনি কোনো দল করেন না। তিনি সমাবেশে যাবেন না, দোকান চালাবেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে যুবলীগের নেতা-কর্মীরা চলে যান।

পরদিন সোমবার সন্ধ্যায় আসাদুজ্জামান, আমিনুল, মো. তারেকসহ তিন-চারজন হাফিজুলের দোকানে আসেন। তাঁরা দোকান থেকে চিকেন ফ্রাই কেনেন। দাম বাবদ ১০০ টাকার একটি নোট দেওয়া হয়। নোটটি ছেঁড়া থাকায় তা বদলে দিতে বলেন হাফিজুল। নোট বদল না করে তাঁরা তর্ক শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁরা হাফিজুলকে এলোপাতাড়ি চড়থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, লাথি মারতে থাকেন। এতে হাফিজুল জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে মিরপুরের বেসরকারি আজমল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে হাফিজুলকে মৃত ঘোষণা করেন।

সজীব মিয়া বলেন, তাঁর ভাইকে মারধরকারীরা যুবলীগের নেতা-কর্মী ছিলেন বলে ভয়ে আশপাশের দোকানকর্মীরা কেউ এগিয়ে আসেননি। তিনি অভিযোগ করেন, যুবলীগের এই নেতা-কর্মীরা তাঁর ভাইসহ আশপাশের দোকান থেকে প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে চাঁদা নিতেন।

সজীব মিয়া জানান, তাঁর ভাই হাফিুজল মিরপুর–১০ নম্বর এলাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকতেন। আর তাঁরা (মা–বাবা ও ভাইবোন) সবাই নরসিংদীতে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। গত সোমবার রাতে ভাইয়ের দোকানের পাশের এক দোকানকর্মীর ফোন পেয়ে তাঁরা ঢাকা আসেন। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ভাইয়ের লাশ দেখতে পান।

এদিকে সোমবার রাতে হাফিজুলকে মারধরের পর মিরপুর এলাকা থেকে আসাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঢাকায় এসে ভাইয়ের লাশ পাওয়ার পর থানায় যান সজীব মিয়া। সেখানে তাঁর সামনেই গ্রেপ্তার আসাদুজ্জামানকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে জানিয়ে সজীব বলেছেন, তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলা করেন তিনি। মামলায় আসাদুজ্জামান ছাড়াও আমিনুল ইসলাম ও মো. তারেককে আসামি করা হয়।

পরে ভাইয়ের দোকানে এসে আশপাশের দোকানকর্মীদের কাছ থেকে পুরো ঘটনা শোনেন বলে জানান সজীব মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেখান থেকেই বুঝতে পেরেছেন, যুবলীগের সমাবেশে যেতে না চাওয়ায় তাঁর ভাইয়ের ওপর এভাবে হামলা হয়েছিল।

আজ দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চিকেন ফ্রাই বিক্রি করা হয়, এ রকম অর্ধশত ভ্যান রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কোনো বিক্রেতা নেই। ওই এলাকার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমিনুল ইসলাম ঢাকা মহানগর ৯৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। আর আসাদুজ্জামান ও তারেক ওই ওয়ার্ড যুবলীগের কর্মী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন (বাবুল) প্রথম আলোকে বলেন, আমিনুল ইসলাম ঢাকা মহানগর ৯৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। গত বছর তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া হত্যায় যুবলীগের আর কেউ জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হত্যা মামলার আসামি হলে পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করবে—এটাই স্বাভাবিক।  

এ মামলায় গ্রেপ্তার আসাদুজ্জামানকে গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশের আবেদনে সাড়া দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। আজ ছিল রিমান্ডের প্রথম দিন।

আসাদুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদে কী পাওয়া গেল, সে বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মিরপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, আসাদুজ্জামান হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুবলীগের সমাবেশে না যাওয়ায় ওই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হাফিজুলকে হত্যা করেছে, এমন অভিযোগ কেউ তাঁদের কাছে করেননি। তবে যে কারণেই হত্যাকাণ্ড ঘটুক না কেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে তা বেরিয়ে আসবে।

এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার দাবি করে হাফিজুলের বড় বোন হাবীবা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যুবলীগের মিটিংয়ে না যাওয়ার কারণেই তাঁর ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। ছেঁড়া নোট নিয়ে হাফিজুলের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়া যুবলীগ নেতা-কর্মীদের অজুহাতমাত্র। তিনি বলেন, হাফিজুলের দেওয়া টাকাতেই গ্রামে তাঁদের সংসার চলত। তাঁকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মা–বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।