ঢাকার উপকণ্ঠে ৫২০ মাদক কারবারি, আছেন জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নারায়ণগঞ্জ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যবর্তী কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

রাজধানীর মালিবাগে উদ্ধার করা মাদক
ফাইল ছবি

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক ছড়িয়ে দেওয়ার ট্রানজিট পয়েন্ট (মধ্যবর্তী কেন্দ্র) হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ। সেখানে মাদকের কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। মাদকের টাকায় গাড়ি-বাড়িও করেছেন কেউ কেউ। পুলিশের হিসাবেই রাজধানীর উপকণ্ঠের ছোট এই জেলায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি মাদক কারবারে যুক্ত আছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক গেছে। তা ছাড়া ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে রয়েছে নৌ যোগাযোগ। সে কারণে ভারত সীমান্তবর্তী দুই জেলা কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে দেশে যেসব মাদক ঢুকছে, সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে এই জেলাকে ‘ট্রানজিট পয়েন্ট’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন মাদক ব্যবসায়ীরা। কেবল তা-ই নয়, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে আসা ইয়াবার চালানও এই জেলায় ঢুকছে।

নারায়ণগঞ্জে মোট কতজন মাদক ব্যবসায় যুক্ত, তার একটি তালিকা গত বছরের শেষের দিকে করেছিল পুলিশ। তাতে জেলার সাতটি থানা এলাকায় ৫২০ জন মাদক কারবারির তথ্য উঠে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭৬ জন সদর থানা এলাকার। ফতুল্লা থানায় ১০৯ জন, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ৯৯ জন, বন্দর থানায় ৬০ জন, রূপগঞ্জ থানায় ৩৮ জন, আড়াইহাজার থানায় ২১ জন এবং সোনারগাঁও থানা এলাকার ১৭ জন মাদক কারবারির নাম রয়েছে তালিকায়।

এখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই মাদক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। পুলিশ মাদক বন্ধে আন্তরিক হলে কখনোই এটা চলতে পারে না।
রফিউর রাব্বি, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটি

পুলিশের এই তালিকায় থাকা কয়েকজনের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও তা উল্লেখ করা হয়নি। আবার প্রথম আলোর অনুসন্ধানে মাদকে যুক্ত বলে তথ্য পাওয়া গেছে, কিন্তু পুলিশের তালিকায় নাম আসেনি, এমন উদাহরণও আছে।

পুলিশের এই তালিকার ১০০ মাদক কারবারিকে নিয়ে অনুসন্ধান করে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে ১০ জনের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা কেউ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আবার কেউ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, যুবদল ও জাতীয় পার্টির বিভিন্ন পদে রয়েছেন। বাকিদের কেউ মাদক বিক্রি, কেউ পাচার ও বহনের সঙ্গে জড়িত।

আমি ও আমার বোনজামাই একসময় মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলাম। গত নির্বাচনের আগে আমি তা ছেড়ে জনপ্রতিনিধি হয়েছি
আড়াইহাজার উপজেলার ব্রা‏হ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. সোহেল

এই জেলায় কতজন মাদকসেবী আছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জে সাতটি মাদক নিরাময়কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে প্রতি মাসে গড়ে ৭০ জন রোগী ভর্তি হন। তবে অধিকাংশ মাদকসেবী নিরাময়কেন্দ্রে আসেন না।

একই সূত্র বলছে, এই জেলায় মাদক কেনাবেচার বড় স্পট বা স্থান রয়েছে ৩৫টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় স্পট রূপগঞ্জের চনপাড়া।

জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের নাম

পুলিশের করা ফতুল্লা থানার মাদক কারবারিদের তালিকায় এক নম্বরে আছেন মীর হোসেন। কুতুবপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক তিনি। তালিকার তথ্য বলছে, মীর হোসেনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনসহ বিভিন্ন আইনে নয়টি মামলা রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, দলীয় পদ থাকার কারণে দীর্ঘদিন মাদক ব্যবসা করলেও মীর হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয় না। মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীও রয়েছে তাঁর। ২০০৯ সালে প্রতিপক্ষের গুলিতে মীর হোসেন মারাত্মক আহত হন, এরপর থেকে তিনি হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। মীর হোসেন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, প্রতিপক্ষের লোকজন যড়যন্ত্র করে তাঁকে মাদক কারবারির তালিকায় ঢুকিয়েছে।

পুলিশের তালিকা বলছে, আড়াইহাজার উপজেলার ব্রা‏হ্মন্দী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. সোহেলের বিরুদ্ধে মাদকের তিনটি মামলা রয়েছে। সোহেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ও আমার বোনজামাই একসময় মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলাম। গত নির্বাচনের আগে আমি তা ছেড়ে জনপ্রতিনিধি হয়েছি।’

জাহাঙ্গীর আলম সিদ্ধিরগঞ্জের চিহ্নিত মাদক কারবারি। স্ত্রী ফরিদা আক্তার তাঁর অন্যতম সহযোগী। এক ডজনের বেশি মামলার আসামি তাঁরা। দুজনই একাধিকবার মাদকসহ ধরা পড়ে কারাগারে ছিলেন।

বজলুর রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য বজলুর রহমান রূপগঞ্জের চনপাড়ার মাদকের কারবারের নিয়ন্ত্রক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁকে গত ১৮ নভেম্বর র‌্যাব গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, মাদকসহ অন্তত ২৩টি মামলা ছিল। গ্রেপ্তারের পর গত ৩১ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তবে তাঁর নাম পুলিশের তালিকায় নেই।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত ইসলামও এলাকায় মাদক কারবারি হিসেবে পরিচিত। তাঁর নামও পুলিশের তালিকায় নেই। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, শাখাওয়াতের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তিনি মাদকসহ গ্রেপ্তারও হয়েছেন। শাখাওয়াত দাবি করেন, ‘২০১৪ সালে একজন পরিচিত পরিবহন ব্যবসায়ীর গাড়িতে মাদক পাওয়া গেলে আমি তদবির করতে থানায় যাই। সেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আমার কথা-কাটাকাটি হয়। এর জেরে তিনি আমাকে মাদক মামলায় ফাঁসান।’

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে পুলিশের তালিকা ও তালিকার বাইরে থাকা আরও ১৫ জন মাদক কারবারির নাম পাওয়া গেছে, যাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদে রয়েছেন। এ ছাড়া পুলিশের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের বড় অংশ মাদক বহনের সঙ্গে জড়িত। তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ও একজন অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন আরও আগেই। একজন চার বছর আগে বিদেশে চলে গেছেন।

জেলায় অনেকগুলো মাদকের বড় চালান ধরা পড়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখেছি, এসব মাদকের চালানের কোনো কোনোটির গন্তব্য ছিল ঢাকা ও আশপাশের জেলা।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল

চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, তালিকায় নাম নেই

জাহাঙ্গীর আলম সিদ্ধিরগঞ্জের চিহ্নিত মাদক কারবারি। স্ত্রী ফরিদা আক্তার তাঁর অন্যতম সহযোগী। এক ডজনের বেশি মামলার আসামি তাঁরা। দুজনই একাধিকবার মাদকসহ ধরা পড়ে কারাগারে ছিলেন। মাদক ব্যবসা করে তিনি গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন। তবে তাঁর নাম পুলিশের মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় নেই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজিতে তাঁর দোতলা বাড়ি। সেখান থেকে নারায়ণগঞ্জসহ ঢাকায় ইয়াবা সরবরাহ করেন। এর পাশেই তাঁর আরেকটি পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে। স্থানীয় লোকজন মনে করেন, পুলিশের সঙ্গে সখ্য থাকায় তালিকায় তাঁর নাম আসেনি।

ধরাছোঁয়ার বাইরে পৃষ্ঠপোষকেরা

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার তদন্তের দুর্বলতার কারণে মাদক কারবারের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। মূলত মাদকসহ যাঁরা ধরা পড়েন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মাদকের উৎস, গন্তব্য এবং নেপথ্যে কারা যুক্ত, তা বেশির ভাগ মামলার তদন্তে উঠে আসে না।

এলাকার মাদক ব্যবসায়ী ও অপরাধজগৎ সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন নারায়ণগঞ্জের সাতটি থানার এমন ১৫ জনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা পুলিশের তালিকা দেখে বলেছেন, মাদক কারবারের পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদের নাম তালিকায় আসেনি।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলায় অনেকগুলো মাদকের বড় চালান ধরা পড়েছে। আমরা তদন্ত করে দেখেছি, এসব মাদকের চালানের কোনো কোনোটির গন্তব্য ছিল ঢাকা ও আশপাশের জেলা।’ তিনি বলেন, এখন মাদক ব্যবসা হয় ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে। তাই বাহককে ধরার পর তদন্তে বেশি দূর এগোনো যায় না।

তবে জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে পুলিশের পক্ষে নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করা সম্ভব হয় না। সেই কারণেই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করা হয়নি। পৃষ্ঠপোষক অনেকের নাম আসেনি। এটা পুলিশের একটা কাঠামোগত দুর্বলতা।’

পুলিশের দুর্বলতার কারণেই মাদক বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখানে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই মাদক ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। পুলিশ মাদক বন্ধে আন্তরিক হলে কখনোই এটা চলতে পারে না।

রফিউর রাব্বি বলেন, মাদক ধরা পড়লেও অনেক সময় মূল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। আবার অপরাধী ধরা পড়লেও এমন ধারায় মামলা দেওয়া হয়, যাতে সহজে তাঁরা জামিন পেয়ে যান। এ জন্য মাদক ব্যবসা বন্ধ হয় না।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন মজিবুল হক, নিজস্ব প্রতিবেদক, নারায়ণগঞ্জগোলাম রাব্বানী, সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ]