গাজীপুরের টঙ্গীতে আসবাব তৈরির একটি কারখানায় সাড়ে আট বছর আগে খুন হন এর ব্যবস্থাপক মো. আহসান কবির ওরফে হাসান (৪৫)। তিন বছর তদন্ত করে হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তে ব্যর্থ হয় থানা–পুলিশ। এরপর তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আড়াই বছর তদন্তে সিআইডিও ব্যর্থ হয়। কাউকে অভিযুক্ত না করেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় আদালতে। অবশেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে জানা গেল, পরিচিতজনেরাই আহসানকে খুন করেন।
টঙ্গীর হাসান লেনের দত্তপাড়ায় একটি আসবাবের কারখানার ব্যবস্থাপক ছিলেন আহসান। তিনি একাই কারখানার ভেতরে থাকতেন। ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি কারখানার তালা ভেঙে ভেতর থেকে তাঁর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শরীর থেকে নাক ছিল বিচ্ছিন্ন। চোয়ালের ওপরে মাংসও ছিল না। বুকে ছিল স্ক্রু ড্রাইভার ঢোকানো এবং পুরুষাঙ্গ ছিল ক্ষতবিক্ষত।
লাশ উদ্ধারের পরদিন আহসানের ভাই বাবু তালুকদার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে টঙ্গী থানায় মামলা করেন। পুলিশ তখন ধারণা করে, ২৭ জানুয়ারি রাত থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে কোনো এক সময় খুন হন আহসান। লাশ কারখানার ভেতরে রেখে বাইরে থেকে তালা দিয়ে পালিয়ে যান খুনিরা।
আহসানের বাড়ি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির সুটিয়াকাঠিতে। খুনের চার দিন আগে ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি বাড়িতে যান তিনি। দুদিন পর কর্মস্থলে ফেরেন। এর দুদিন পরে ২৯ জানুয়ারি টঙ্গী থানা-পুলিশ আহসানের ছোট ভাই বাবু তালুকদারকে ফোন করে ভাই খুন হওয়ার খবর জানায়।
পিবিআই সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত টঙ্গী মডেল থানার ছয়জন উপপরিদর্শক (এসআই) আহসান হত্যা মামলার তদন্ত করেন। এ সময় পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করলেও তাঁরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। ২০১৮ সালের ২৫ মার্চ সিআইডি মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায়। সিআইডির একজন পরিদর্শক ও একজন এসআই ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আড়াই বছর তদন্ত করে একজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে হত্যাকাণ্ডে তাঁর সম্পৃক্ততা না পেয়ে ওই ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে এবং কাউকে অভিযুক্ত না করে সিআইডি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি আদালত সিআইডির প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে পিবিআই গাজীপুরের প্রধানকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। আদালতের আদেশে বলা হয়, ‘পূর্ববর্তী তদন্তকারী কর্মকর্তা সুষ্ঠু তদন্ত করেন নাই। তিনি মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল করিয়াছেন।’
এ ব্যাপারে জানতে আহসান হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া সেই সিআইডি কর্মকর্তা ও সিআইডির তৎকালীন পরিদর্শক মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তাঁর মুঠোফোনে কল করে ও খুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
আদালতের নির্দেশের পরে ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি গাজীপুরে পিবিআইয়ের তৎকালীন পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমানকে মামলাটি তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) কর্মরত।
সম্প্রতি হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আহসান ওই কারখানায় একাই থাকতেন। রাতের আঁধারে হত্যাকাণ্ড হওয়ায় প্রত্যক্ষদর্শী ও কোনো সূত্র ছিল না। খুনিরা তাঁর মুঠোফোনটিও নষ্ট করে দেয়।
হাফিজুর রহমান বলেন, তদন্তে নেমে সূত্রের (সোর্স) মাধ্যমে জানতে পারেন আহসান খুন হওয়ার মাস দুয়েক আগের একটি ঘটনা। স্থানীয় কয়েকজন যুবক কারখানায় বসে মাদক সেবন ও আড্ডা দিলে তাঁদের বাধা দিয়েছিলেন আহসান। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হয়। তাঁরা আহসানকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। ঝগড়ার সূত্র ধরে তদন্তে নেমে জানতে পারেন, হুমকিদাতারা মাদক কারবারি ও চাঁদাবাজ। কারখানার ভেতর মাদক সেবন করতে বাধা দেওয়ার জেরে আহসানকে খুন করেন তাঁরা।
পুলিশ পরিদর্শক হাফিজুর রহমান আরও জানান, তদন্তের একপর্যায়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আজিজুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির ও জাফর ইকবাল নামের তিনজন মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পরই আহসান হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে। হত্যার ঘটনায় আজিজুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবির আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।
আহসান হত্যা মামলায় আটজনকে আসামি করে গত জুলাই মাসে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পিবিআই। আজিজুল (২৮), হুমায়ুন (৪০) ও জাফর (৪৩) ছাড়া অন্য পাঁচ আসামি হলেন সজীব সরকার (৪১), সাইদুর রহমান (৩৮), সাখাওয়াত হোসেন (৩৭), বাপ্পী তালুকদার (৪০) ও বুলেট (৪০)। তাঁদের মধ্যে সজীব, সাখাওয়াত, বাপ্পী ও বুলেট পলাতক। আর সাইদুর জামিনে রয়েছেন।
তদন্ত–সংশ্লিষ্ট পিবিআই সূত্রে জানা যায়, সজীব টঙ্গীতে মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর স্বজনেরা এলাকায় প্রভাবশালী। তাঁর সঙ্গে মামলার অপর তিন আসামি বাপ্পী, সাখাওয়াত ও জাফরের ভালো সম্পর্ক ছিল। এদিকে বুলেট এলাকার দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ। সজীব ও বুলেট একসঙ্গে ইয়াবা সেবন করতেন। সজীবকে এই ইয়াবা সরবরাহ করতেন বাপ্পী। সাখাওয়াত রাজধানীর উত্তরখানে মাদকের কারবার করতেন। ইতালিপ্রবাসী এক বাংলাদেশি হত্যা মামলারও আসামি তিনি।
মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র ও তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ওই কারখানার মালিক মাইন উদ্দিন রাজধানীর উত্তরায় ব্যবসা করেন। তিনি কারখানায় থাকতেন না। এ সুযোগে প্রভাব খাটিয়ে আসামিরা কারখানার ভেতরে মাদক সেবন ও কেনাবেচা করতেন। আহসান বাধা দিলে মানতেন না। বিষয়টি জানতে পেরে মাইনউদ্দিন কারখানা ব্যবস্থাপক আহসানের সঙ্গে এ নিয়ে রাগারাগি করেন। মাদকসেবী ও কারবারিরা যাতে কারখানায় ঢুকতে না পারেন, তাঁকে সে ব্যবস্থা নিতে বলেন। এরপর বাধা দিতে গেলে আহসানের সঙ্গে তাঁদের ঝগড়া বাধে। আহসানকে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন তাঁরা।
২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে আসামিরা কারখানার সামনে যান। কারখানার ফটক খুলে দিতে বললে প্রথমে আপত্তি জানান আহসান। ভয় দেখালে পরে খুলে দেন। এরপর তাঁরা কারখানায় ঢুকে মাদক সেবন শুরু করেন। এই সময় আহসান বলে ওঠেন, ‘কারখানায় ইয়াবা খাওয়া যাবে না।’
এ কথা শুনে ক্ষুব্ধ হন আট আসামি। তাঁরা আহসানকে মারধর করেন। এ সময় আসামিদের মধ্যে সজীব অন্যদের বলেন, ‘আহসান মাস্তান হয়ে গেছে।’ তাঁকে ‘শেষ করে দিতে’ সবাইকে নির্দেশ দেন তিনি। এ সময় বাপ্পী আহসানের মুখ এবং অন্যরা শরীরের বিভিন্ন জায়গা চেপে ধরেন। একপর্যায়ে বুলেট একটি স্ক্রু ড্রাইভার এনে হাতুড়ির আঘাতে সেটি আহসানের বুকে ঢুকিয়ে দেন। সাইদুর বাটালি দিয়ে তাঁর নাক ও থুঁতনিতে আঘাত করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর আজিজুল বাইরে গিয়ে দেখেন আশপাশে কেউ নেই। পরে লাশ রেখে কারখানার বাইরে তালা দিয়ে চলে যান তাঁরা।
মামলাটির তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পিবিআই গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদের রহমান। থানা-পুলিশ ও সিআইডি কেন হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি জানতে চাইলে গত শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, থানা-পুলিশ ও সিআইডি হত্যাকাণ্ডের সূত্র মেলাতে পারেনি। কারা কারখানায় আসতেন, সেটা খুঁজে বের করার ওপর জোর দিয়েছিল পিবিআই। এ জন্য কয়েকজন ‘সোর্স’ নিয়োগ করা হয়। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতেই হত্যাকাণ্ডের সূত্র পাওয়া গেছে।
নিহত আহসান কবিরের স্ত্রী ছাবিহা বেগম দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তাঁর একটি মুঠোফোন ছিল। সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় টাকার অভাবে ঠিক করতে পারছেন না। আহসানের ভাই জুয়েল তালুকদারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ছাবিহা বেগম কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তিনি জীবিত থাকাকালে বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু স্বামী খুন হওয়ার পর টাকার অভাবে বড় ছেলে ও মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ছোট ছেলের বয়স তখন তিন মাস। তার জন্য দুধ কিনতে পারেননি। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি, তিন সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকতে জালি ব্যাগ সেলাইয়ের কাজ নিয়েছেন। তাতেও সংসার চলছে না।
ছাবিহা বেগম বলেন, ‘ঘরের জমিটুকু ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্পত্তি নেই। তিন বেলার জায়গায় দুই বেলাও বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি ও সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে পারি না। বড় ছেলে সাব্বিরও (২২) বেকার। কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছে না। আমি, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছি। কেউই টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না।’
স্বামীর হত্যার ন্যায়বিচার চেয়ে ছাবিহা বলেন, ‘এই হত্যাকারীদের জন্য আজ আমরা বিপর্যস্ত। ওই খুনিদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়, এখন সেটাই একমাত্র চাওয়া।’