নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ

ডিবি হেফাজতে আলালের মৃত্যু নিয়ে অনেক প্রশ্ন

আলাল উদ্দিন
ছবি: সংগৃহীত

গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে ঢাকার তুরাগ এলাকা থেকে আলাল উদ্দিনকে (৫০) ধরে আনার ১০ দিন পর পরিবারকে খবর দেওয়া হয় তিনি মারা গেছেন। আলাল ওই এলাকার একটি ভবনের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। ওই ভবনের একটি ফ্ল্যাট থেকে এক নারীর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তবে আলালকে গ্রেপ্তারের সময়, তাঁর আহত হওয়া, হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে নানা প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাচ্ছে না।  

সুস্থ আলাল উদ্দিনকে ধরে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যুর খবরে মুষড়ে পড়া পরিবারের অভিযোগ, আলালকে ডিবি হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এই অভিযোগের প্রেক্ষাপটে আলালের লাশের সুরতহাল করেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু তিনি মৃতদেহের সুরতহালের সঙ্গে আলালের মৃত্যু নিয়ে অভিমত দিয়েছেন, যেখানে দৃশ্যত ডিবিকে ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হয়েছে।

সুস্থ আলাল উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ডেকে নিয়ে যান ডিবি কর্মকর্তারা। পরের ১০ দিন তাঁর বিষয়ে কোনো তথ্যই জানানো হয়নি। ১৬ জুন মারা গেলে লাশ আনার জন্য খবর দেওয়া হয়।
পারভীন আক্তার, আলাল উদ্দিনের স্ত্রী

এক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনুসন্ধান ছাড়াই ম্যাজিস্ট্রেট আলালের আহত হওয়ার দিনক্ষণ উল্লেখ করেছেন। যেটা আলালকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে দেওয়া ডিবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। যদিও ঘটনা সংশ্লিষ্ট থানা–পুলিশের কাছ থেকে ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে।

আলালের মৃত্যু নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের এভাবে অভিমত দেওয়াটা কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ফৌজদারি আইন বিষয়ক অভিজ্ঞ আইনজীবীরা। তাঁদের ভাষ্য, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডিবিকে দায়মুক্তি দিতে অতি উৎসাহী হয়ে সুরতহাল প্রতিবেদনে ‘তদন্তেপ্রাপ্ত’ তথ্য উল্লেখ করেছেন।

ঘটনা যা ঘটেছিল

গত ৬ জুন তুরাগ থানার বাউনিয়ার একটি ভবনের ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাট থেকে ফাতেমা আক্তার (৩১) নামে ওই নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর স্বামী সাইফুল ইসলামের আরেক স্ত্রী রয়েছে। তিনি মাঝে মাঝে এই বাসায় এসে থাকতেন। এই দম্পতির কোনো সন্তান নেই। আলাল ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। লাশ উদ্ধারের পর ওই দিনই আলালের বাসায় গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তুরাগ থানা-পুলিশ। এরপর ওই দিনই ডিবি পরিচয়ে একদল লোক আলালকে ধরে নিয়ে আসে বলে পরিবারের অভিযোগ।

আলালের স্ত্রী পারভীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সুস্থ আলাল উদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে ডেকে নিয়ে যান ডিবি কর্মকর্তারা। পরের ১০ দিন তাঁর বিষয়ে কোনো তথ্যই জানানো হয়নি। ১৬ জুন মারা গেলে লাশ আনার জন্য খবর দেওয়া হয়। তিনি অভিযোগ করেন, ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে আলালের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। সেই নির্যাতনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

আমাদের সামনে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি সুস্থ ছিলেন নাকি অসুস্থ ছিলেন সেভাবে খেয়াল করিনি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি চেয়ারও এগিয়ে দিয়েছেন। তখন তার শরীরের কোথাও কোনো ব্যান্ডেজ ছিল না।
শরীফুল ইসলাম, পরিদর্শক (তদন্ত), তুরাগ থানা

আলালের মৃত্যুর পর আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে ডিবি বলেছে, গত ৫ জুন ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ফাতেমা আক্তারকে হত্যা করেন আলাল উদ্দিন। ধর্ষণ চেষ্টার সময় ধ্বস্তাধস্তিতে আলাল হাতে ও পায়ে জখমপ্রাপ্ত হন। তারপর তিনি নিজেকে আড়াল করতে পলাতক হন। ১০ জুন হাতে ও পায়ে বান্ডেজ করা অবস্থায় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) সামনে থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৬ জুন শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে আলালকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

আলালের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে ঢাকা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটও লিখেছেন, আলাল উদ্দিন ৫ জুন বিকেলে এক নারীকে ধর্ষণচেষ্টার সময় হাতে ও পায়ে জখমপ্রাপ্ত হন। তবে ৬ জুন ডিবি পরিচয়ে আলালকে তুলে নেওয়ার আগে তুরাগ থানা-পুলিশ আলালের বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখন আলাল সুস্থ ছিলেন বলে জানান জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা।

তুরাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শরীফুল ইসলামের নেতৃত্বে সেদিন আলালকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। শরীফুল ইসলাম গত ২ জুলাই মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলালকে তাঁর বাসায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। এমনিতেতো আমাদের সামনে তিনি হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি সুস্থ ছিলেন নাকি অসুস্থ ছিলেন সেভাবে খেয়াল করিনি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি চেয়ারও এগিয়ে দিয়েছেন। তখন তার শরীরের কোথাও কোনো ব্যান্ডেজ ছিল না।’

মাত্র ২৮ মিনিটে রহস্য উদ্ঘাটন নিয়ে প্রশ্ন

আদালতে দেওয়া ডিবির প্রতিবেদন মতে, ১০ জুন দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে পঙ্গু হাসপাতালের মূল ফটক থেকে আলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তাঁর হাত ও পায়ে ব্যান্ডেজ ছিল। অসুস্থ হওয়ার কারণে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয় ১টা ৫৮ মিনিটে। অর্থাৎ গ্রেপ্তার ও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া পর্যন্ত ২৮ মিনিট তিনি ডিবির হেফাজতে ছিলেন। ডিবি বলছে, আলালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে তিনি ধর্ষণচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ওই নারীকে খুন করেছেন। ধ্বস্তাধ্বস্তির সময় তিনি কীভাবে হাতে ও পায়ে আঘাত পেয়েছেন সেই বর্ণনাও দিয়েছেন আলাল। অর্থাৎ গ্রেপ্তারের ২৮ মিনিটের মধ্যেই রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছে ডিবি।

মাত্র ২৮ মিনিটে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি করলেও আলাল চারদিন কোথায় ছিলেন সেটা বের করতে পারেনি ডিবি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত ১০ জুলাই ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ডিবির সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। ওই দিনই ডিবির উত্তরা বিভাগের ডিসি আকরামুল হকের সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি জবাব দেননি।

পরে গত ২৩ জুলাই ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুককে তাঁর স্টাফ অফিসারের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠানো হয়। তিনিও এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা জানিয়ে ডিবির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ফাতেমা আক্তার হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে ২৪ জুলাই যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে মন্তব্য করবেন না।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের মুঠোফোনে প্রথম ২৬ জুলাই যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে বার্তা পাঠালেও তিনি জবাব দেননি। হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠিয়েও তাঁর কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এরপরও কয়েক দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর মুঠোফোনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের কল করলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে মুঠোফোনে বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব দেননি।

আলালের চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যে গরমিল

আলালকে গ্রেপ্তার ও হাসপাতালে ভর্তির তথ্য জানিয়ে ১১ জুন আদালতে প্রথম প্রতিবেদন দেয় ডিবি। তাতে উল্লেখ করা হয়, ১০ জুন দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে আলালকে অসুস্থ অবস্থায় গ্রেপ্তারের পর পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১০ জুন এই নামে কোনো রোগী পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নেননি বা ভর্তি হননি। গত ২ ও ৩ জুলাই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের নিবন্ধন খাতা বারবার পরীক্ষা করেও আলাল উদ্দিন নামে কোনো রোগীর তথ্য পাওয়া যায়নি।

আলালের মৃত্যুর পরদিন ১৭ জুন ডিবি আদালতে আরেকটি প্রতিবেদন দেয়। সেখানে আলাল ৬ দিন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, এমন একটি ছাড়পত্র সংযুক্ত করা হয়। তাতে বলা হয়, আলাল উদ্দিন ১০ থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত পিংক-১ ইউনিটে ভর্তি ছিলেন। ওই ছাড়পত্রে একটি নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ ছিল। অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিবন্ধন নম্বরটি আলাল উদ্দিনের নয়, রহিম নামে এক রোগীর। তাঁর বয়স ৪৮ বছর। বাবার নাম করিম। ঠিকানা টঙ্গী-গাজীপুর। তিনি ভায়োলেট-১ ইউনিটে ভর্তি ছিলেন।

হাসপাতালে ভর্তির তথ্য সংরক্ষণ করা হয়, এমন আরেকটি নিবন্ধন খাতা পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে রহিমের নাম কেটে আলাল উদ্দিন করা হয়েছে। বয়স-৪৮ বছর কেটে লেখা হয় ৫০। বাবার নাম করিম কেটে করা হয়েছে নুর উদ্দিন দেওয়ান। আর ঠিকানা টঙ্গী-গাজীপুর কেটে করা হয়েছে তুরাগ-ডিএমপি।

সুরতহাল প্রতিবেদন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হামিদা মুস্তফা নিজে লেখেননি বলেও জানান। তিনি বলেন, তাঁর নির্দেশনায় পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলো তার লেখা বলেই ধরে নিতে হবে।

ডিবি আলাল উদ্দিনের চিকিৎসা সংক্রান্ত যে ব্যবস্থাপত্রটি সাংবাদিকদের দেয়, সেটি তৈরি করা হয় জরুরি বিভাগের টিকিটের ওপর। সেই টিকিটেও রহিম কেটে আলাল উদ্দিন করা হয়েছে। বয়স ৪৮ কেটে ৫০ করা। ওই ব্যবস্থাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, কথিত রোগী রহিম ভায়োলেট-১ ইউনিটের অধীনে ক্যাজুয়ালটি বিভাগে ভর্তি। ক্যাজুয়ালটি বিভাগে গিয়ে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ করা হয়, এমন একাধিক খাতা পরীক্ষা করেও দেখা যায়, ৪৮ বছর বয়সী রহিম এই ইউনিটে ১০ জুন ভর্তি হয়েছেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন নথিতে রহিমের নাম কেটে আলাল উদ্দিন করা হয়েছে।

হাসপাতালের ভায়োলেট-১ ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক আবদুস সালাম ২৫ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, আলাল উদ্দিন নামে কোনো রোগী ভর্তি হননি। তবে রহিম নামে পুলিশ হেফাজতে যে রোগী ভর্তি হয়েছিলেন ১১ জুন তিনি (আলালের মৃত্যুর পাঁচ দিন আগে) নিজের নাম, বাবার নাম, বয়স এবং ঠিকানা পরিবর্তনের জন্য হাসপাতালের পরিচালক বরাবর আবেদন করেন। পরে সব নথিতে তাঁর নাম আলাল উদ্দিন করা হয়।

ডিবির দেওয়া পঙ্গু হাসপাতালের ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ রয়েছে, সেখানে ভর্তির দুদিন আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আলাল উদ্দিনের হাতে ও পায়ে ব্যান্ডেজ করা হয়। অর্থাৎ আলাল ৮ জুন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন। কে বা কারা তাঁকে সেখানে নিয়েছে, সেটি ডিবি জানায়নি।

গত ১৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বরাবর লিখিত আবেদন করে আলাল উদ্দিনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। ১৬ জুলাই হাসপাতালটির ওয়ার্ড মাস্টার রিয়াজ উদ্দিন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালের ব্যবস্থাপত্রও সরবরাহ হয়। দুদিন পর রিয়াজ উদ্দিন প্রথম আলোকে জানান, আলাল উদ্দিন বা রহিম নামে কোনো রোগী ৮ জুন ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়েছেন–এমন তথ্য তাঁরা খুঁজে পাননি।

যা বললেন ম্যাজিস্ট্রেট

আলালের মৃত্যুর প্রায় ১৭ ঘণ্টা পর তাঁর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন করেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হামিদা মুস্তফা। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় তদন্তে তিনি জেনেছেন, ঢাকার তুরাগের একটি বাসায় গত ৫ জুন ধর্ষণচেষ্টার ব্যর্থ হয়ে ফাতেমা আক্তার নামে নারীকে হত্যা করেন আলাল উদ্দিন। ধর্ষণ চেষ্টার সময় ধ্বস্তাধস্তিতে আলাল উদ্দিন আহত হয়ে পলাতক হন। ১০ জুন ডিবি তাঁকে গ্রেপ্তার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৬ জুন আলাল উদ্দিনের মৃত্যু হয়।

তবে পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, আলাল উদ্দিন বলেছেন, তিনি ভর্তি হওয়ার দুই দিন আগে (৮ জুন) দৌড়ে পালাতে গিয়ে আহত হয়েছেন। তবে কোথায়, কীভাবে আহত হয়েছেন, এসব প্রশ্নতো আর চিকিৎসক করেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হামিদা মুস্তফা স্বীকার করেন, ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে তিনি কথা বলেননি। ঘটনাস্থল তুরাগে যাননি। প্রথম তদন্তকারী সংস্থা তুরাগ থানা-পুলিশের সঙ্গেও কথা বলেননি। তিনি শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশের একজন এসআইয়ের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন।

সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেটের অভিমত দেওয়ার সমালোচনা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের লাশের বাহ্যিক অবস্থা বর্ণনা করার কথা। এর বাইরে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেলে, তিনি একটি অভিমত দিতে পারেন। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এভাবে কাউকে দায়মুক্তি দিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদনে মন্তব্য করার সুযোগ নেই।

এ ঘটনার তদন্তের কোনো পর্যায়েই শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশ সম্পৃক্ত ছিল না। সেখানকার একজন এসআইয়ের সঙ্গে কথা বলে এমন ‘স্পর্শকাতর’ ঘটনায় সিদ্ধান্তে চলে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে হামিদা মুস্তফা বলেন, আলাল উদ্দিন শেরেবাংলা নগর থানাধীন জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউটে মারা গেছেন। ওই থানায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। এ জন্য ওই থানার এসআইয়ের সঙ্গে কথা বলে তিনি ধারণার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি ওই এসআইয়ের নাম বলতে পারেননি।

সুরতহাল প্রতিবেদন হামিদা মুস্তফা নিজে লেখেননি বলেও জানান। তিনি বলেন, তাঁর নির্দেশনায় পুলিশ সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে যা উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলো তার লেখা বলেই ধরে নিতে হবে।

এ বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, আলাল উদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো অপমৃত্যু মামলা হয়নি। সাধারণ ডায়েরি মূলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট লাশের সুরতহাল করেছেন। আর আলাল উদ্দিনের মৃত্যুর বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানা-পুলিশের কোনো মন্তব্য করার সুযোগ নেই।

সুরতহাল প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ম্যাজিস্ট্রেটের অভিমত দেওয়ার সমালোচনা করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের লাশের বাহ্যিক অবস্থা বর্ণনা করার কথা। এর বাইরে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পেলে, তিনি একটি অভিমত দিতে পারেন। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এভাবে কাউকে দায়মুক্তি দিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদনে মন্তব্য করার সুযোগ নেই।

ডিবি হেফাজতে আলাল উদ্দিনের মৃত্যুর তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আলাল উদ্দিন একজন নিরাপত্তা কর্মী হতে পারেন, তাঁরও মানবাধিকার আছে। তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী থাকলে, সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।