সীমান্তের অরক্ষিত ১৪৬ পয়েন্ট দিয়ে আসছে মাদক

রাজধানীর মালিবাগে উদ্ধার করা মাদক
ফাইল ছবি

দেশে সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অঞ্চল দিয়ে মাদক আসার ১৪৬টি অরক্ষিত পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে স্থল ও নৌপথে ৬৬টি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ভয়ংকর মাদক আইস ও ইয়াবা।

অন্য পয়েন্টগুলো দিয়ে ভারত থেকে হেরোইন, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের প্রচলিত-অপ্রচলিত মাদক আসছে। এই পয়েন্টগুলো দেশের ১৯টি সীমান্তবর্তী জেলার মধ্যে পড়েছে। অধিদপ্তর বলছে, পয়েন্টগুলো অরক্ষিত থাকায় সহজেই দেশে মাদক আসছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন রুটে মিয়ানমার ও ভারত থেকে মাদক আসায় ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান আইস বা ক্রিস্টাল মেথ (মেথএমফিটামিন) আসার পরিমাণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় নতুন উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ সোমবার দেশে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস পালিত হচ্ছে। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘মানুষই মুখ্য: মাদককে না বলুন, শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলুন’।

কোন পথ দিয়ে দেশে মাদক আসছে, এটি সব সংস্থাই জানে। কিন্তু জানার পরও সীমান্ত পেরিয়ে দেশে মাদক আসছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক
উদ্ধার করা ইয়াবা

ডিএনসি গত বছরের জুন মাসে সীমান্তে ৯৫টি অরক্ষিত পয়েন্ট দিয়ে বেশি মাদক আসার তথ্য দিয়েছিল, যা বেড়ে এবার হয়েছে ১৪৬টি।

ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, সবচেয়ে বেশি ৬৬টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। এই পয়েন্টগুলো কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এই দুই জেলার যেসব পয়েন্ট অরক্ষিত, সেগুলো খুবই দুর্গম। এই দুই জেলায় এমন অনেক পয়েন্ট রয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও যাননি। এই পয়েন্ট দিয়ে আগে আসত ইয়াবা। এখন ইয়াবার সঙ্গে আইসও আসছে। নাফ নদী ও সাগরপথে মাছ ধরার ট্রলারে করেও বিভিন্ন রুটে আইস ও ইয়াবা আসছে।

যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের ১৩টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢুকছে ফেনসিডিল। উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ৮ জেলার ২৯টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিল ও গাঁজা আসছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লার ৯টি পয়েন্ট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।

ডিএনসি বলছে, চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে দেশে ৬৬ কেজি আইস বা ক্রিস্টাল ম্যাথ উদ্ধার হয়েছে। ২০১৯ সালের শুরুর দিকেও দেশে অপ্রচলিত মাদক ছিল আইস। তবে এখন এটি অপ্রচলিত কোনো মাদক নয়। শুরুতে ‘পরীক্ষামূলকভাবে’ ইয়াবার চালানের সঙ্গে অল্প পরিমাণে আইস আসত।

এখন আইস আনতে বিপুল টাকা খরচ করছেন ইয়াবার কারবারিরা। কারণ, ইয়াবার চেয়ে এই মাদক বিক্রি করলে লাভ বেশি। তবে ইয়াবা আসাও বন্ধ হয়নি। ২০২২ সালে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯টি। এর আগের বছর ২০২১ সালে ইয়াবা উদ্ধারের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫।

ডিএনসি বলেছে, দেশের পশ্চিমাঞ্চলের নওগাঁ জেলার সীমান্তবর্তী সাতটি নতুন রুট দিয়ে ফেনসিডিল আসছে। সাতক্ষীরার সাতটি পয়েন্ট দিয়ে আসছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ২৪টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিলের পাশাপাশি হেরোইন আসছে।

এ ছাড়া যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের ১৩টি পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢুকছে ফেনসিডিল। উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের ৮ জেলার ২৯টি পয়েন্ট দিয়ে ফেনসিডিল ও গাঁজা আসছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লার ৯টি পয়েন্ট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬টি পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (নিরোধ শাখা) মানজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর যেসব পয়েন্ট দিয়ে বেশি মাদক আসছে, এগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। স্থলপথে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। আর উপকূলীয় অঞ্চলে কোস্টগার্ড দায়িত্ব পালন করে। এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে জানানো হয়েছে। সীমান্তে মাদকসংক্রান্ত কোনো তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে জানানো হয়। কখনো কখনো একসঙ্গে অভিযানও চালানো হয়।

সীমান্তের অরক্ষিত পয়েন্ট দিয়ে মাদক আসার বিষয়ে একাধিকবার চেষ্টা করেও বিজিবি ও কোস্টগার্ডের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে অধিদপ্তরের জনবলের ঘাটতি, প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাবসহ বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

পাচার হচ্ছে বিপুল অর্থ

মাদক ও অপরাধ প্রতিরোধে কাজ করা জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনওডিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে (২০২৩) বাংলাদেশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে আনুমানিক ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। চার ধরনের মাদক ক্রয় করে মাদক কারবারিদের মাধ্যমে এই অর্থ পাচার হচ্ছে। যদিও পাচার করা টাকার হিসাব অনুমানভিত্তিক।

ইউএনওডিসির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মাদক কারবারিরা সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করে ফেনসিডিল ক্রয়ে। ফেনসিডিল ক্রয়ে দেশ থেকে পাচার হয় ২১৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। এরপরই মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ক্রয়ের মাধ্যমে পাচার করা হয় ১৪০ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া হেরোইন ক্রয় করে ৬৬২ কোটি এবং ইনজেকটিং মাদক ক্রয়ে ৬৭৫ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।

সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর যেসব পয়েন্ট দিয়ে বেশি মাদক আসছে, এগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। স্থলপথে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। আর উপকূলীয় অঞ্চলে কোস্টগার্ড দায়িত্ব পালন করে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (নিরোধ শাখা) মানজুরুল ইসলাম

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, দেশ থেকে মাদক কারবারিদের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও জড়িতদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না। কারণ, দেশের বাইরে অর্থ পাচারসংক্রান্ত বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। এমনকি অর্থ পাচারসংক্রান্ত মামলার তদন্তে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে দেশের বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও সুনির্দিষ্টভাবে জড়িতদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, কোন পথ দিয়ে দেশে মাদক আসছে, এটি সব সংস্থাই জানে। কিন্তু জানার পরও সীমান্ত পেরিয়ে দেশে মাদক আসছে।

এ থেকে সহজেই বোঝা যায় মাদক আসা বন্ধে দায়িত্ব পালনকারী সংস্থাগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। সীমান্ত দিয়ে মাদক এলে, স্বাভাবিকভাবেই সেটি ছড়িয়ে পড়বে। সীমান্তে মাদক আসা রোধ করতে না পারলে মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব।