কম টাকায় দামি মুঠোফোন পেয়ে অনেকেই খুশি হয়ে যান। যাচাই–বাছাই না করেই কিনে নিয়ে সেগুলো ব্যবহার শুরু করেন। এ জন্য অনেককেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চাপের মুখে কেউ কেউ সহজেই এ ধরনের মুঠোফোন দিয়ে দেন। আর যাঁরা সেটা না করেন, তাঁদের ধরতে চলে অভিযান।
এ ধরনের মুঠোফোন উদ্ধারে কাজ করা পুলিশ সদস্যরা বলছেন, চুরি হওয়া বা হারিয়ে যাওয়া মুঠোফোন গোপনে ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। এসব মুঠোফোন চালু করলেই সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়। কারণ, যেকোনো মুঠোফোন চালু হলে সেটার আইএমইআই নম্বর দিয়ে ব্যবহারকারীকে ধরা যায়। এ ক্ষেত্রে ওই আইএমইআই নম্বরের বিপরীতে কোন সিম ব্যবহার হচ্ছে, তা বের করতে হয়। আর সেটা পাওয়া গেলে ব্যবহারকারীর অবস্থান সহজেই পাওয়া যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দুজন কর্মকর্তা খোয়া যাওয়া মুঠোফোন উদ্ধারে বেশ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তাঁরা হলেন খিলগাঁও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিল্টন কুমার দেবদাস এবং গুলশান থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল কাদির। মিল্টনের দাবি, সাড়ে তিন বছরে খোয়া যাওয়া সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি মুঠোফোন উদ্ধার করেছেন তিনি। আর এএসআই কাদিরের ভাষ্যমতে, সাত বছরে সাড়ে চার হাজারের বেশি মুঠোফোন উদ্ধার করেছেন তিনি।
এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহারকারী মুঠোফোনটি তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে কেনেন। কম দামে খোয়া যাওয়া মুঠোফোন কিনে তিনি নিজেই ভুক্তভোগী হয়ে যান। এ কারণে অনেকেই মুঠোফোনটি ফেরত দেন। সাধারণত তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
কাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সে বিষয়ে ওই দুই কর্মকর্তা বলেছেন, মুঠোফোন চুরি হলে, ছিনতাইকারী নিয়ে গেলে ভুক্তভোগী থানায় এসে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ফলে ছিনতাই বা চুরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তবে চুরি বা ছিনতাইয়ের মামলা হলে মুঠোফোন উদ্ধারের পাশাপাশি জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এএসআই আবদুল কাদির বলেন, কম দামে পান বলে অধিকাংশ মুঠোফোনই তরুণেরা কেনেন। কখনো কখনো স্কুল-কলেজপড়ুয়া তরুণেরাও এসব মুঠোফোন কিনে থাকেন। মুঠোফোন কেনার সময় অবশ্যই ক্রয় রসিদ এবং মুঠোফোনের সঙ্গে দেওয়া বক্সটি নিতে হবে। তারপর মুঠোফোনের আইএমইআই এবং বক্সের আইএমইআই নম্বর মিলিয়ে দেখে সেটি কিনতে হবে। তা না হলে ক্রেতা-বিক্রেতা যেকোনো ধরনের আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে যেতে পারেন।
মুঠোফোন খোয়া গেলে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে। যদি ছিনতাই বা চুরি হয়, তবে থানায় মামলা করতে হবে। মুঠোফোন কেনার সময় যে বক্সটি দেয়, সেটি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ, ওই বক্সে আইএমইআই নম্বর থাকে। জিডিতে ওই আইএমইআই নম্বর উল্লেখ করতে হবে। কারণ, মুঠোফোন চালু করা হলে আইএমইআই নম্বরের সূত্র ধরেই এর অবস্থান শনাক্ত করা হয়। যদি আইএমইআই নম্বর না থাকে, তবে মুঠোফোন নম্বর জিডি বা মামলায় উল্লেখ করতে হবে। তারপর সংশ্লিষ্ট মুঠোফোন অপারেটরের সিম তুলে ফেলতে হবে।
এসআই মিল্টন কুমার বলছিলেন, ছাত্রজীবনে তাঁর একটি মুঠোফোন হারিয়ে যায়। সেই মুঠোফোনটি আর ফেরত পাননি। ২০১৩ সালে পুলিশে যোগ দেওয়ার পর মানুষ হারানো মুঠোফোনের বিষয়ে সহায়তা চাইলে ছাত্রজীবনের সেই ঘটনা মনে পড়ে। তখন সাধারণ মানুষের কষ্ট তিনি অনুধাবন করতে পারেন। তারপর খোয়া যাওয়া মুঠোফোন উদ্ধারে বিশেষ নজর দেন। একটি মুঠোফোন উদ্ধার করে সেটি ফিরিয়ে দেওয়ার পর প্রকৃত মালিকের যে হাসিমাখা মুখটি দেখতে পান, তাতে এই কাজে আরও বেশি উৎসাহিত হন।
এএসআই আবদুল কাদিরও ২০১৫ সালের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, তখন তিনি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় কর্তব্যরত কর্মকর্তার সহকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। এক নারী তখন থানায় এসে কান্না করছিলেন। জানান, বাস থেকে নামার পর তিনি আর মুঠোফোনটি পাচ্ছেন না। ওই নারী বলছিলেন, মুঠোফোনটি বেশি দামি নয়। তবে এটি তাঁর বাবার দেওয়া সর্বশেষ স্মৃতি। মুঠোফোনে তাঁর বাবার ছবিও আছে। সেটি উদ্ধারের আকুতি জানান তিনি। তখন তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়, মুঠোফোনটি উদ্ধার করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহায়তায় তিন মাস পর বরিশাল থেকে মুঠোফোনটি উদ্ধার করে ওই নারীকে ফেরত দেওয়া হয়। তখন তাঁর আবেগ দেখে মনে হয়েছে, মুঠোফোন উদ্ধার করেও মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা সম্ভব।
এএসআই আবদুল কাদির বলেন, একটি মুঠোফোনের সঙ্গে মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। এমনকি এমন মুহূর্তের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে মুঠোফোনে, যা হারিয়ে মানুষ অনেক কষ্ট পায়। যখনই খোয়া যাওয়া মুঠোফোন মানুষকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তারা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁদের এমন আবেগ দেখে সত্যিই তখন অনেক গর্ব অনুভব করেন। এখন মনে হয় এই সেবাটা সত্যিই এক অনন্য সেবা। মুঠোফোন উদ্ধার করায় এখন পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনার ১৮ বার পুরস্কৃত করেছেন। একবার আইজি ব্যাচও পেয়েছেন।
এসআই মিল্টন কুমার দেবদাসও চারবার ডিএমপি কমিশনারের কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মুঠোফোন উদ্ধার করে সেটি ফিরিয়ে দিতে পারলে মানুষের আনন্দ দেখে সত্যই অনেক গর্ব হয়।
একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে মিল্টন কুমার বলেন, ‘একজন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক তাঁর মুঠোফোন হারিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। পাঁচ বছর পর তিনি অনুরোধ করেন মুঠোফোনটি উদ্ধার করা যায় কি না। প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে দেখা যায় মুঠোফোনটির অবস্থান কক্সবাজারে। ওই ব্যক্তিকে ফোন করা হলে জানান, পেশায় তিনি একজন মাঝি। মুঠোফোনটি খোয়া গেছে জানালে মাঝি বলেন, তিনি সেটি ফেরত দেবেন। অন্যের মুঠোফোন তিনি ব্যবহার করবেন না। কুরিয়ারে সেটি তিনি পাঠিয়ে দেন। মাঝির কথা শুনে সত্যিই অবাক হয়েছি। আর ওই চিকিৎসক তাঁর মুঠোফোনটি পেয়ে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না।’
দুজন পুলিশ কর্মকর্তাই বলেছেন, মুঠোফোন যেন খোয়া না যায়, সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে। কিছু সতর্কতাও অবলম্বনের পরামর্শ দেন তাঁরা। বিশেষ করে একান্ত মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও মুঠোফোন থেকে সরিয়ে নিরাপদে সংরক্ষণ করা জরুরি। কারণ, মুঠোফোন খোয়া গেলে সেটি ভালো মানুষের হাতে না–ও পড়তে পারে। তখন নানা ধরনের বিপদ হতে পারে। এসব ছবি ও ভিডিওর কারণে ‘ব্ল্যাকমেলের’ শিকারও হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আবার এগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে।
মুঠোফোন সব সময় সামনের পকেটে রাখার পরামর্শ দেন এসআই মিল্টন কুমার দেবদাস। কারণ, সামনের পকেট থেকে খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। একই ধরনের পরামর্শ দিয়ে এএসআই আবদুল কাদির বলেন, গণপরিবহনে ওঠার সময় মুঠোফোন হাতে থাকলে খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আর সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং উবারের গাড়িতে ওঠার সময় সেই গাড়ির নম্বরটি টুকে নিয়ে পরিচিত কাউকে পাঠিয়ে দিলে মুঠোফোন হারালেও সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হবে।