ইভ্যালি-আলেশা মার্টে আটকা টাকা, কারও পড়া বন্ধ, কেউ পলাতক

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে এখনো অন্ধকারে গ্রাহকেরা
প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারিতে চাকরি চলে যায় ঢাকার গোড়ান এলাকার বাসিন্দা কামরুল হাসানের। নিজের জমানো পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি থেকে ছাড়ে মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন পণ্য কিনে বিক্রি শুরু করেছিলেন। লাভও হচ্ছিল।

একপর্যায়ে আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ঋণ করে ৩৫-৫০ শতাংশ ছাড়ে ইভ্যালি ও আলেশা মার্টে পণ্যের ফরমাশ করেন। আর এরপরেই পড়েন বিপদে।
হঠাৎ গত বছরের জুন-জুলাই মাস থেকে পণ্য দেওয়া বন্ধ করে দেয় দুটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানই। এতে এতগুলো টাকা আটকে যায় কামরুলের। ধারের টাকা শোধ করতে না পেরে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি।

কামরুল বলেন, ‘অনেকবার সময় দিয়েও টাকা ফেরত দেয়নি প্রতিষ্ঠান দুটি। চার-পাঁচ মাস ধরে টাকার জন্য বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন বাসায় আসা শুরু করেছেন। পরে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আজ মামাতো ভাইয়ের বাসায় তো কাল খালাতো ভাইয়ের বাসায়। এভাবেই দিন কাটছে আমার।’
কামরুল বিনিয়োগের এই টাকা কখন ফেরত পাবেন কিংবা আদৌ পাবেন কি না, সেই নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না।

বাবার পেনশনের টাকা ইভ্যালিতে

কামরুলের মতোই বিপদে পড়েছেন পাবনার বেড়া উপজেলার সারোয়ার আলম। রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করছিলেন। বন্ধুদের দেখাদেখি পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা শুরু করেছিলেন।

সারোয়ার বাবার পেনশনের টাকা তুলে ইভ্যালিতে ১০ লাখ টাকার মোটরসাইকেল ফরমাশ করেছিলেন। গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৫ শতাংশ ছাড়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পাঁচটি মোটরসাইকেল অর্ডার করেছিলাম। কয়েক দফা সময় নিয়েও পণ্য দেয়নি ইভ্যালি। পরে কয়েকটি ব্যাংক চেকের মাধ্যমে মূল টাকা ফেরত দিয়েছিল। কিন্তু সেই চেকগুলো দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারিনি।’

বাবার পেনশনের টাকা এভাবে আটকে যাওয়ায় পরিবারের সামনে মুখ দেখাতে পারছেন না সারোয়ার। পড়া বন্ধ করে দিয়ে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগে কাজ করছেন। এদিকে পাওনা টাকা ফেরত না দিয়ে ইভ্যালি আবার ব্যবসা শুরু করেছে।

আবার ব্যবসায় ইভ্যালি

পুরোনো গ্রাহকদের পাওনার বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট না করেই নতুন করে আবার ব্যবসা শুরু করেছে ইভ্যালি। গত সোমবার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, মুঠোফোন বিক্রির জন্য নতুন করে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি (পণ্য নেওয়ার সময় অর্থ পরিশোধ)’; ‘পিক অ্যান্ড ক্যাশ বিফোর ডেলিভারিতে (আগে অর্থ পরিশোধ পরে পণ্য)’ উপভোগ করুন আপনার পছন্দের ব্র্যান্ডের আকর্ষণীয় সব পণ্য নামে বিজ্ঞাপন দেখা গেছে।

গত এপ্রিলে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের আটটি মামলা এবং চেক প্রত্যাখ্যানের ২০টি মামলায়  জামিনে মুক্তি পান ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন। ৭ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গ্রাহকের কাছে ইভ্যালির দেনা ৪০০ কোটি টাকার কম। সার্ভার চালু করে দেওয়া হলে ইভ্যালি প্রকৃত হিসাব দিতে পারবে।

৮ অক্টোবর এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ইভ্যালির ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন  শামীমা নাসরিন। কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে তিনি ইভ্যালি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন।

ওই সংবাদ সম্মেলনে শামীমা নাসরিন বলেন, গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে এক বছর নিরবচ্ছিন্ন ব্যবসা করতে চান। তিনি আশাবাদী যে এক বছর ব্যবসা করতে পারলে বিনিয়োগ পাবেন এবং তা থেকে সব দেনা পরিশোধ করা সম্ভব। ২৮ অক্টোবর থেকে নতুন ক্যাম্পেইন শুরু করবেন বলেও জানান তিনি।

গতকাল বুধবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় শামীমা নাসরিনের  বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গ্রাহক, মার্চেন্ট ও অন্যান্য সংস্থার কাছে ইভ্যালির দেনা ছিল ৫৪৩ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে দেওয়া ফোন নম্বরে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। ইভ্যালির বর্তমান কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়নি।

বেশির ভাগ গ্রাহকই টাকা ফেরত পাননি

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনে টাকা ও পণ্য ফেরত না পাওয়া ১০ জন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, মুনাফার আশায় তাঁরা ই-কমার্স থেকে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। সরকার থেকে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও টাকা ফেরত পাননি তাঁরা।

গত জুলাই মাসে আলেশা মার্টের প্রতারণার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে ‘আলেশা মার্ট কাস্টমার অ্যাসোসিয়েশন’। এতে সংগঠনের সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আলেশা মার্টের কাছে ৪৬ হাজার গ্রাহক বিভিন্ন পণ্য অর্ডার করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৭ হাজার গ্রাহক প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য পাবেন। তিনি আরও বলেন, এই ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গেটওয়েতে থাকা ৪২ কোটি টাকা গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি টাকা আজও ফেরত পাননি গ্রাহকেরা।

একইভাবে গত জানুয়ারি মাসে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের ২০ জন গ্রাহক ফেরত পেয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, কিউকমের পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান ফস্টার করপোরেশন লিমিটেডের কাছে আটকা আছে ৩৯৫ কোটি টাকা।
গ্রাহকদের ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের মাঝামাঝি আলোচনায় আসে আরেকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বনানী থানার সাময়িক বরখাস্ত পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানা। পরে ভারতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন তিনি। গত এক বছরে তাঁকে দেশে ফেরাতে পারেনি পুলিশ।

অন্যদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ পাচারের মামলাগুলো তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, ই-কমার্সের নামে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা পাচার করেছে আনন্দের বাজার, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাসহ আটটি প্রতিষ্ঠান। তারা হুন্ডির মাধ্যমে এই টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে তথ্য পেয়েছে সিআইডি।

কী বলছে সরকার

গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ার সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল।মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, টাকা ফেরত চলমান প্রক্রিয়া। যেসব প্রতিষ্ঠান মামলায় জড়ানো এবং গত বছরের ৩০ জুনের আগে যাদের টাকা আটকে গেছে, সেগুলোর ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু করার বাস্তবতা নেই।

অন্ধকারে গ্রাহকেরা

ইভ্যালি নতুন করে ব্যবসা শুরু করলেও এখন পর্যন্ত পুরোনো গ্রাহকদের কারও অর্থ ফেরত দেয়নি। গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়নি ই-অরেঞ্জও। আলেশা মার্ট ও কিউকম কিছু অর্থ ফেরত দিলেও গ্রাহকের পাওনার বিপরীতে সেটা খুবই সামান্য।
গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়া এবং কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে সরকারের কাছে কার্যকরী মূলধন সুবিধা হিসেবে ৩০০ কোটি টাকার অর্থ সহায়তা চেয়েছে আলেশা মার্ট। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য নিরাপত্তাও চেয়েছে তারা। এ জন্য গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আলাদা দুটি চিঠি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

বর্তমানে আলেশা মার্ট, কিউকম ও ই-অরেঞ্জের লেনদেন বন্ধ। পাচারের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকেরা টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগের সফলতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ফলে পাওনা টাকা নিয়ে এখনো অন্ধকারেই আছেন গ্রাহকেরা।