চার দশকের বেশি সময় আগে ১৯৭৫ সালে অভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের চার কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় করা মামলা সচল হচ্ছে।
ওই মামলা বাতিল প্রশ্নে রুল খারিজ (ডিসচার্জ) করে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার রায় দিয়েছেন। ফলে এক যুগ পর মামলাটি সচল হচ্ছে এবং নিম্ন আদালতে মামলার কার্যক্রম চলতে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের চার কর্মকর্তা হলেন, তৎকালীন উপমহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) মনিরুল আলম, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ এফ এম সিদ্দিক, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আকমল খান ও চিত্রগ্রাহক ফিরোজ কাইয়ুম চৌধুরী।
ওই মামলা বাতিল চেয়ে আসামি সাবেক হাবিলদার আলতাফ হোসেন হাইকোর্টে ২০০৫ সালে আবেদন করেন। একই বছরের ২৫ মে হাইকোর্ট মামলা বাতিল প্রশ্নে রুল দেন। এরপর ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল উচ্চ আদালত মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন। হাইকোর্টের দেওয়া রুল ও স্থগিতাদেশের বিষয়টি চলতি মাসের শুরুতে আদালতে তুলে ধরে রাষ্ট্রপক্ষ। পরে বিষয়টি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম রাবেয়া। আলতাফের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. ওয়াজি উল্লাহ, মো. হারুন অর রশিদ ও শেখ রেজাউল হক।
রায়ের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সামিরা তারান্নুম রাবেয়া প্রথম আলোকে বলেন, এক যুগ ধরে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত ছিল। সম্প্রতি রাষ্ট্রপক্ষ রুল শুনানির উদ্যোগ নেয়। হাইকোর্ট রুল খারিজ করে রায় দিয়েছেন। এতে করে মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ নেই। এখন মামলাটি সচল হচ্ছে এবং নিম্ন আদালতে মামলার কার্যক্রম চলতে কোনো বাধা নেই।
আলতাফ হোসেন জামিনে আছেন বলে জানান তাঁর আইনজীবী মো. হারুন অর রশিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আলতাফসহ নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে আসা অপর তিনজন (আবুল কাশেম, আব্দুল আউয়াল সরকার ও লুৎফর রহমান) উচ্চ আদালতে মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেন।
তাদের আবেদনের ওপর চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০০৫ সালের ১৭ এপ্রিল হাইকোর্ট তিনজনের ক্ষেত্রে মামলাটি বাতিল করে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেননি। এখন রুল খারিজ হওয়ায় আলতাফসহ অপর ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলাটি চলবে। তবে আবেদনকারীর (আলতাফ) অভিপ্রায় অনুসারে আপিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বিটিভি ও বেতার স্টেশনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। একই বছরের ৭ নভেম্বর ওই চার কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। তখন দাবি-দাওয়া নিয়ে বিটিভির তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কল্যাণ সমিতির আন্দোলন চলছিল। বিটিভির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের দাবি মানতে রাজি হচ্ছিল না। সে সময় রামপুরা টিভি ভবনে নিয়োজিত ছিলেন সেনাবাহিনীর হাবিলদার আলতাফ হোসেন। বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। পরবর্তীতে চার কর্মকর্তার খোঁজ না পেয়ে ১৯৭৫ সালের ১৯ নভেম্বর তাঁদের স্ত্রীরা গুলশান থানায় অপহরণ মামলা করেন। তিন মাস ১৭ দিন পর বিটিভি ভবনের পেছনের ঝিল থেকে ১৯৭৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনটি কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। পরীক্ষার পর কঙ্কালগুলো মনিরুল, সিদ্দিক ও আকমলের বলে চিহ্নিত করা হয়। তবে কাইয়ুমের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যমতে, মামলার তদন্ত শেষে কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তদন্ত-কর্মকর্তা ১৯৭৮ সালে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ১৯৯৬ সালের ২৫ নভেম্বর আকমলের স্ত্রী মামলা পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রী ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। ১৯৯৭ সালের ২০ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মামলা তদন্ত করার জন্য সিআইডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
একই বছরের ২৫ মার্চ সিআইডি মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে ঢাকার সিএমএম আদালত আবেদন করে। আদালত আবেদন গ্রহণ করলে মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, ১৯৯৯ সালের ১৮ আগস্ট আলতাফ হোসেনসহ নয়জনের অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। তখন মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তারও করে। পরে তাঁরা জামিন পান। ২০০২ সালের ৭ আগস্ট মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসে। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট নয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ছিল। সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে মামলার কার্যক্রম বাতিল চেয়ে ২০০৫ সালে হাইকোর্টে আবেদন করেন আলতাফ। এই আবেদনের আজ চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো।