শেষ হচ্ছে না ৪১ মামলার বিচার

২০০৫ সালে জেএমবি দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়েছিল। এতে দুজন নিহত ও আহত হন ১০৪ জন।

দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার ১৮তম বার্ষিকী আজ ১৭ আগস্ট। ওই হামলায় দুজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ১৮ বছর আগের এই দিনে মুন্সিগঞ্জ বাদে দেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে পাঁচ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)।

ওই ঘটনায় জেএমবির সদস্যদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর মধ্যে ৪১টির বিচার এখনো শেষ হয়নি।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নির্মূল করা না গেলেও জেএমবির সাংগঠনিক অবস্থা অনেক দুর্বল। বড় ধরনের হামলা করার সামর্থ্য এখন আর তাদের নেই।

এখন সাক্ষী এনে বিচারাধীন মামলাগুলোর সাক্ষ্য শেষ করা হবে। আর যদি সাক্ষী না-ই আসে, তাহলে আগে যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলাগুলোর রায় দিতে তাঁরা আদালতে আবেদন করবেন।
কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটে

সৌদি আরবে লেখাপড়া করা জামালপুরের শায়খ আবদুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে জেএমবি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা একের পর এক রক্তক্ষয়ী হামলা চালায়। সংগঠনটি ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায় সিনেমা হল ও সার্কাস মাঠে বোমা হামলা চালায়। একই বছরের ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শহরের চারটি সিনেমা হলে একযোগে বোমা হামলা চালান জেএমবির সদস্যরা। এতে শিশু, নারীসহ ১৮ জন নিহত হন। ২০১৩ সালে অন্তত অর্ধশত হামলায় জড়িত ছিল জেএমবি। এসব হামলায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। রাজধানীর গোপীবাগে ছয় খুন ও রাজাবাজারে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের উপস্থাপক নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যায়ও জেএমবির জড়িত থাকার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

১৭ আগস্টের ওই বোমা হামলার ছয় মাসের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে জেএমবির সাংগঠনিক অবস্থা ভেঙে পড়ে। গ্রেপ্তার করা হয় জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান ও শীর্ষস্থানীয় নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ তৎকালীন সব গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে। ২০০৭ সালে শীর্ষ সাত জঙ্গির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর, অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট (এটি ইউ) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বোমা হামলার ঘটনায় দেশে ১৫৯টি মামলা হয়েছিল। এতে ১ হাজার ১৩০ জনকে অভিযোগপত্রভুক্ত করা হয়। এ পর্যন্ত ১০২টি মামলার বিচার শেষ হয়েছে। রায়ে ৩২৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। এর মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।

‘মূল জেএমবির কার্যক্রম নেই। নব্য জেএমবি কিছু আছে। তাদের অধিকাংশ সীমান্ত পার হয়ে চলে গেছে। তারা যে আসতে পারে না, এমন নয়। সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। তবে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগের মতো তাদের শক্তি বা সামর্থ্য নেই। অনলাইনে তারা সংগঠিত হতে চেষ্টা করছে। তবে অফলাইনে নেই। এটিইউ তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছে।’
এস এম রুহুল আমিন, এটিইউ প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি

মামলাগুলোর রায়ে ৩৫৮ জন খালাস পান। আসামিদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় পুলিশ ১৬টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। এখনো ৪১টি মামলার রায় হয়নি। এর মধ্যে ঢাকার আদালতে পাঁচটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, এখন সাক্ষী এনে বিচারাধীন মামলাগুলোর সাক্ষ্য শেষ করা হবে। আর যদি সাক্ষী না-ই আসে, তাহলে আগে যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে মামলাগুলোর রায় দিতে তাঁরা আদালতে আবেদন করবেন।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, নিষিদ্ধ জেএমবি পুরোপুরি দমন করা যায়নি। জেএমবি থেকে একটা অংশ বেরিয়ে আইএস মতাদর্শীদের সঙ্গে মিলে নতুন জঙ্গি সংগঠন করেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একে নব্য (নিও) জেএমবি নামে অভিহিত করে। এরা ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায়। এরপর পুলিশ ও র‍্যাবের ব্যাপক অভিযানে নব্য জেএমবির বেশির ভাগ নেতা নিহত বা গ্রেপ্তার হন।

এটিইউ প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি এস এম রুহুল আমিন গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল জেএমবির কার্যক্রম নেই। নব্য জেএমবি কিছু আছে। তাদের অধিকাংশ সীমান্ত পার হয়ে চলে গেছে। তারা যে আসতে পারে না, এমন নয়। সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে। তবে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগের মতো তাদের শক্তি বা সামর্থ্য নেই। অনলাইনে তারা সংগঠিত হতে চেষ্টা করছে। তবে অফলাইনে নেই। এটিইউ তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখছে।’

র‍্যাবের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে পুনরায় হামলা বা নাশকতা চালানোর মতো জেএমবি বা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাংগঠনিক অবস্থা নেই। তাই বলে র‍্যাব আত্মতুষ্টিতে ভুগছে না।
খন্দকার আল মঈন, র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার

১৪ আগস্ট ‘পাহাড়ের আস্তানা’ থেকে নেমে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মদা ইউনিয়নের আছকরাবাদ সিএনজিস্ট্যান্ড এলাকা থেকে জনতা জঙ্গি সন্দেহে ১৭ নারী-পুরুষকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। সিটিটিসি বলছে, এরা নতুন জঙ্গি সংগঠন ইমাম মাহমুদের কাফেলার সদস্য। এর তিন দিন আগে শুক্রবার রাত থেকে কর্মদা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিওয়ালি গ্রামের বাইশালী বাড়ি এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একই জঙ্গি সংগঠনের ১০ জন নারী-পুরুষকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি ইউনিট।

র‍্যাব জানায়, জেএমবি ছাড়াও অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে র‍্যাবের অভিযান ও তীক্ষ্ণ নজরদারি অব্যাহত আছে। প্রতিষ্ঠা থেকে র‍্যাব এ নিয়ে তিন হাজারের বেশি জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াসহ গ্রেপ্তার বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কাছ থেকে বিপুল অস্ত্র, গুলি, গ্রেনেড বোমা ও বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, র‍্যাবের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে পুনরায় হামলা বা নাশকতা চালানোর মতো জেএমবি বা অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাংগঠনিক অবস্থা নেই। তাই বলে র‍্যাব আত্মতুষ্টিতে ভুগছে না। বিভিন্ন সময় জঙ্গিরা বিভিন্ন ব্যানারে বিভিন্ন আঙ্গিকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। র‍্যাব তখনই তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে র‍্যাবের অভিযান অব্যাহত আছে। জঙ্গি দমনসহ যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় র‍্যাব প্রস্তুত। ১৭ আগস্ট ঘিরে নাশকতা ও জঙ্গি হামলার ঝুঁকি নেই বলে তিনি গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে জানান।