জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া ইকরামুল হক ওরফে মিলনকে আল–কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ (একিউআইএস) শাখার দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা বলে দাবি করছে পুলিশ। ঢাকায় পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইকরামুল ভারতে জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত ছিলেন। তাঁর ভারতীয় পাসপোর্ট এবং তাঁর স্ত্রীর আধার কার্ডও ছিল।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশের আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতা ওসমান গণি ওরফে আবু ইমরানের ঘনিষ্ঠ, এমন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ইকরামুলকে (৩০) গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের পর সিটিটিসি জানতে পারে, তিনি ভারতে আল–কায়েদার দাওয়া শাখার প্রধান। ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আসামি হিসেবে তাঁকে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও খুঁজছিল। তাঁর দুটি সাংগঠনিক ছদ্মনাম রয়েছে আবু তালহা ও মাওলানা সাবেত।
সস্ত্রীক গ্রেপ্তার হওয়া ইকরামুল হক বর্তমানে কারাগারে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট বলছে, গত ৩০ মে ঢাকার মাদারটেক থেকে ইকরামুল ও তাঁর স্ত্রী ফারিয়া আফরিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর কয়েক দফায় হেফাজতে এনে তাঁদের দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আদালতের নির্দেশে এই দম্পতিকে পরে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে ইকরামুলের পরিবারের দাবি, ইকরামুল ও তাঁর স্ত্রীকে ৩০ এপ্রিল ময়মনসিংহ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। এ সময় তাঁদের শিশুসন্তানও সঙ্গে ছিল।
অবশ্য সিটিটিসির কর্মকর্তারা এই দাবি নাকচ করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ৩০ মে ঢাকায় অভিযান চালিয়ে ইকরামুল ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের সঙ্গে শিশুসন্তান ছিল। সন্তান এখন কারাগারে মায়ের সঙ্গে আছে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দি, মামলার এজাহার ও তদন্তকারী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ইকরামুলের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের সদর উপজেলার বোরোরচর গ্রামে। তিনি ঢাকার ফরিদাবাদ মাদ্রাসা থেকে ২০১৭ সালে দাওরায়ে হাদিস পাস করেন। মাদ্রাসায় পড়াশোনার সময় আনসার আল ইসলামের বর্তমান আমির ওসমান গণির মাধ্যমে জঙ্গিবাদে জড়ান। ইকরামুল ২০১৮ সালে ভারতে দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি আল–কায়েদা নেটওয়ার্কের (একিউআইএস) সঙ্গে যুক্ত হন এবং একপর্যায়ে সংগঠনের দাওয়া বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেন।
সিটিটিসি সূত্র বলছে, ইকরামুল একপর্যায়ে ভারতীয় পাসপোর্টও জোগাড় করেন। তাতে নাম রয়েছে নূর হোসেন, পিতা সাবু মিয়া ও মা নাবিয়া বিবি। ভারতীয় পাসপোর্টে তাঁর ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারের দিনহাটা এলাকা। তাঁর স্ত্রী ফারিয়া আফরিনও ভারতীয় আধার কার্ড করেন। নাম দেন মরিয়ম খাতুন। ইকরামুল একিউআইএসের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা বা উপপ্রধান। তিনি সংগঠনটির দাওয়াতি শাখার প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতে অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। মাস সাতেক আগে স্ত্রীকে নিয়ে অবৈধ পথে ইকরামুল বাংলাদেশে ফেরত আসেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড (এটিএস) গত ২৪ মে একিউআইএসের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গুজরাট থেকে বাংলাদেশি চার তরুণকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ সজীব, মুন্না খালেদ আনসারি, আহারুল ইসলাম ও মমিনুল আনসারি। তাঁরা ইকরামুল হক নামে বাংলাদেশির মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানান। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছেও এ তথ্য আসে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত বছর ১১ অক্টোবর ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক খবরে বলা হয়, ওই দেশের মধ্যপ্রদেশের ভুপাল থেকে তিন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে দেশটির ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া সূত্রে উত্তর প্রদেশ থেকে আরও আটজনকে গ্রেপ্তার করে সন্ত্রাসবিরোধী স্কোয়াড (এটিএস)।
এটিএসের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাতে প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয়, তাঁরা একিউআইএস, জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের সদস্য। একিউআইএস ও বাংলাদেশের জেএমবি ভারতে নেটওয়ার্ক বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
ঢাকার একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ভারতের এটিএস গত বছর থেকে ইকরামুলকে খুঁজছিল। তারা আবু তালহা নামেই খুঁজছিল। পরে জানতে পারে এই ব্যক্তি বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। চলতি বছরের মাঝামাঝি তাঁর ব্যাপারে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তথ্য পান। অবশ্য এক মাস আগেই ইকরামুলকে সিটিটিসি গ্রেপ্তার করে। যদিও সেটা শুরুতে ওই গোয়েন্দা সূত্র জানতে পারেনি।
সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ইরামুলের স্ত্রী ফারিয়া আফরিনও জঙ্গি সংগঠনের নারী শাখার সদস্য। আনসার আল ইসলামের বর্তমান আমির ওসামান গণি ওরফে আবু ইমরান এবং মুখপাত্র তামিম আল আদনানীর সঙ্গেও ইকরামুলের যোগাযোগ ছিল।
সিটিটিসির উপকমিশনার এস এম নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের পর ইকরামুল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে ঢাকার সবুজবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে। এই দম্পতিকে তিন দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁদের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত জানা গেছে। এর মধ্যে ইকরামুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তিনি বলেন, একিউআইএসের ২৩ শীর্ষ নেতার অন্যতম ইকরামুল।
ইকরামুল গ্রেপ্তার হওয়ায় এই জঙ্গিগোষ্ঠীর বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা নস্যাৎ করা গেছে বলে দাবি করেন পুলিশ কর্মকর্তা নাজমুল হক।