‘ক্যাসিনো সাঈদ’ দেশে ফেরেন পাসপোর্ট ছাড়াই

যুবলীগের সাবেক নেতা এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ
যুবলীগের সাবেক নেতা এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ

যুবলীগের সাবেক নেতা এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ ওরফে ‘ক্যাসিনো সাঈদ’–এর দেশে ফেরার কোনো তথ্য নেই ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে। তাঁর পাসপোর্টের তথ্য বলছে, সাড়ে তিন বছর আগে তিনি আকাশপথে সিঙ্গাপুর গেছেন আর ফেরেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি এখন ঢাকায়। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। এখন মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার আবার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

সরকার ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের অন্য নেতাদের মতো সাঈদও আলোচনায় আসেন। তিনি তখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (মতিঝিল–আরামবাগ এলাকা) কাউন্সিলর ছিলেন। একই সঙ্গে মতিঝিল ও আরামবাগের বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাবের ক্যাসিনো বা জুয়ার অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন। এ কারণে তিনি ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ নামে পরিচিতি পান। তখন ক্যাসিনো–কাণ্ডে যুবলীগের মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী (সম্রাট), সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ অনেকে গ্রেপ্তার হলেও সাঈদ ধরা পড়েননি। কারণ, অভিযান শুরুর কয়েক দিন আগেই তিনি দেশের বাইরে চলে যান। এরপর ওই বছরের ১৭ অক্টোবর তাঁকে কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণ করে সরকার। পরে তাঁর বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থ লেনদেন ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। পরবর্তী সময়ে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেন।

দেশে ফিরে ক্যাসিনো সাঈদ প্রথম প্রকাশ্যে আসেন ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন হকি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির নিয়মিত সভায় আকস্মিকভাবে হাজির হন। তাঁকে স্বাগত জানান ফেডারেশনের সভাপতির পদে থাকা বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নানসহ কমিটির সদস্যরা। সভা শেষে এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যদি অন্য কোনো বাধা না থাকে, তাহলে সাঈদ যোগ দেবেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।’

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, মমিনুল হক ২০১৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সিঙ্গাপুরে যান। সে সময় তিনি যে পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে গিয়েছিলেন, সেই পাসপোর্টে দেশে ফিরে আসার কোনো তথ্য ইমিগ্রেশন বিভাগের কাছে নেই।

পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেউ দেশে ফিরলে তাঁর তথ্য ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে থাকে। ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে তাঁর দেশে ফেরার তথ্য নেই মানে তিনি অবৈধভাবে দেশে ফিরেছেন।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মমিনুল হক সাঈদের মুঠোফোন নম্বরে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। প্রথম আলোর প্রতিবেদক পরিচয়ে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠালে তিনি সাড়া দেন। কী প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই, সেটা জানতে চান। এরপর ফিরতি বার্তায় তিনি কীভাবে দেশে ফিরেছেন, সেটা জানতে চাওয়া হয়। এরপর তিনি আর উত্তর দেননি।

গতকাল বুধবার বেইলি রোডে তাঁর বাসায় গেলে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ভবনের নিরাপত্তাকর্মী জামাল খানের সঙ্গে। জামাল খান ইন্টারকমে সাঈদের বাসায় ফোন দিয়ে এই প্রতিবেদকের কথা জানান। কিছুক্ষণ পরে ওই বাসা থেকে ইন্টারকমে নিরাপত্তাকর্মীকে বলা হয়, সাঈদ বাসায় নেই।

পরে এ বিষয়ে সাঈদের আইনজীবী শাহিনুর ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জামিন আবেদনের শুনানির দিন তিনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তবে মমিনুল হক সাঈদ কীভাবে দেশে ফিরেছেন, সেই তথ্য তাঁর (আইনজীবীর) জানা নেই।

ক্যাসিনো

অবশ্য পুলিশ ও যুবলীগের একটি সূত্র বলছে, সাঈদ ভারত হয়ে দেশে ফিরেছেন। তিনি অবৈধ পথে সীমান্ত পার হয়ে গোপনে দেশে ঢুকেছেন। এরপর ৩০ জানুয়ারি উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করেন। আদালত তাঁকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে হাজির হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা একটি মামলায় জামিন চান। সেদিনই তিনি ওই মামলায় জামিন পান।

দেশে ফিরে ক্যাসিনো সাঈদ প্রথম প্রকাশ্যে আসেন ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ফ্যালকন হলে হকি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির নিয়মিত সভায় আকস্মিকভাবে হাজির হন তিনি। তাঁকে স্বাগত জানান ফেডারেশনের সভাপতির পদে থাকা বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নানসহ কমিটির সদস্যরা। সভা শেষে এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মমিনুল হক সাঈদ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কমিটিতে ঢুকবেন। এ ব্যাপারে যদি কোনো নীতিগত বাধা না থাকে, তাহলে আমার পক্ষ থেকে তো কোনো বাধা নেই। এখানে যাঁরা কমিটির অন্যান্য সদস্য আছেন, সবাই মিলে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে অনুমতি দিয়েছেন। যদি অন্য কোনো বাধা না থাকে, তাহলে তিনি যোগ দেবেন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।’

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর আগে ২০১৯ সালের এপ্রিলে মমিনুল হক সাঈদ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হন। ক্যাসিনো–কাণ্ডে নাম আসার পর তাঁকে এই পদ থেকে ২০২০ সালের আগস্টে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।

মমিনুল হক সাঈদ বর্তমানে ঢাকার বেইলি রোডের একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। এ কে এম মমিনুল হক সাঈদের পাসপোর্টে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা রয়েছে। আর বর্তমান ঠিকানা হিসেবে বঙ্গভবন স্টাফ কোয়ার্টারের একটি ঠিকানা উল্লেখ করেছেন। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাঈদের বাবা এ কে এম জহিরুল হক একসময় বঙ্গভবনে দরজির কাজ করতেন। বাবার চাকরির সূত্রে বঙ্গভবনের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন তাঁরা।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি সূত্র জানায়, ঢাকায় বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাবে ক্যাসিনো বা জুয়া চালুর পর সাঈদের নিয়ন্ত্রণে ছিল মোহামেডান, আরামবাগ, ওয়ান্ডারার্স ও দিলকুশা ক্লাব।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে প্রায় তিন বছর পর গোপনে দেশে ফেরার তথ্য জামিন পাওয়ার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও কারও কাছে ছিল। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, তখন অনেকের ধারণা ছিল, তিনি রাজনৈতিকভাবে কোনো একটা বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এ কারণে দেশে ফেরার পর তাঁকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে সবুজসংকেত পাওয়া যায়নি।

মতিঝিল এলাকার আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাসিনো সাঈদ দেশে ফেরার পর মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট হয়েছেন। অনুসারীদের নিয়ে মতিঝিলের ঢাকা মেরিনার ইয়াংস ক্লাবে প্রায় রাতে আড্ডা দেন। তাঁর অনুসারীরা এরই মধ্যে কয়েকজনের ওপর হামলাও করেছেন। আরও অনেককে হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এর মধ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি মতিঝিল ৯ নম্বর ওয়ার্ড মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আহম্মেদ ইসলামের ওপর হামলা হয়। তিনি মতিঝিল থানায় মামলা করলে মমিনুল হক সাঈদের দুই অনুসারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

আহম্মেদ ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাঈদের অনুসারীরা আমিসহ তিনজনের ওপর হামলা করে এবং ৮৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। ৯ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছিলাম। পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁরা জামিনে এসে আবার হুমকি দিচ্ছেন।’

পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, হামলার ঘটনায় পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। কারও নির্দেশে এই হামলা হয়েছে কি না, সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।