রাজধানীতে অপরাধ বেড়েছে। বেশি বেড়েছে খুন, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা ও মাদকসংক্রান্ত অপরাধ। অবশ্য কমেছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনক।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মামলার উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীতে ২০২২ সালে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৪৯টি, যা আগের বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি। এই বছরে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬১ হাজার ৪৯৪ জন। সংখ্যাটি আগের বছর ছিল ৫০ হাজারের মতো।
২০২২ সালে খুন হয়েছেন ১৭৩ জন। ২০২১ সালে সংখ্যাটি ছিল ১৫২। চুরির ঘটনায় মামলার সংখ্যা বেড়েছে ২৮ শতাংশ। ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০৩টি। দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে ১৪৫টি, আগের বছর দস্যুতার ঘটনা ছিল ১৩৪টি।
সাধারণ চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করার ঝক্কিতে যেতে চান না। ফলে মামলার সংখ্যা দিয়ে প্রকৃত চিত্র বোঝা যায় না। মামলার যে চিত্র উঠে এসেছে, তাকেই উদ্বেগজনক বলে মনে করেছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও দস্যুতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মানুষের কর্মসংস্থানের অভাব। এ কারণে মানুষের জীবনমানের অবনতি হয়েছে। টিকতে না পেরে মানুষ অপরাধে জড়িয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতা, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, প্রতিহিংসা, পরকীয়া ও মাদক বাড়লে খুনের ঘটনা বাড়ে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। এরপর মার্কিন ডলারের দাম বাড়ে, যা সব পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। চাপের মধ্যে থাকা অর্থনীতি সংকটে পড়ে যায়। সরকারি হিসাবে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা ছিল ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপে উঠে আসে, আগস্টে খাদ্য কিনতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন ৬৮ শতাংশ মানুষ।
রাজধানীর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ৫০টি থানাকে ৮টি অপরাধ বিভাগে ভাগ করে কাজ করে ডিএমপি। বিভাগগুলো হলো রমনা, লালবাগ, ওয়ারী, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর, গুলশান ও উত্তরা। এই আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ওয়ারী বিভাগে, ৩৭টি। এ ছাড়া মিরপুরে ৩১টি, গুলশান ও মতিঝিলে ২১টি করে, উত্তরা ও লালবাগে ১৭টি করে, রমনায় ১৬টি এবং তেজগাঁও বিভাগে ১৩টি খুনের ঘটনা ঘটে।
শুধু ২০২২ সাল নয়, আগের বছরগুলোর অপরাধপ্রবণতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওয়ারী বিভাগ ও মিরপুরে খুনের ঘটনা বেশি ঘটে। ডিএমপির কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব এলাকায় ভাসমান মানুষ বেশি বাস করে এবং ঘনবসতিপূর্ণ, সেসব এলাকায় খুনের ঘটনা বেশি ঘটে। ওয়ারী বিভাগের মধ্যে রয়েছে ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, গেন্ডারিয়া, কদমতলী ও ওয়ারী থানা।
২০২২ সালে ঢাকায় রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেছে তিনটি—মতিঝিল, ওয়ারী ও গুলশানে। আগের বছর কোনো রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেনি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এ কে এম হাফিজ আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিটি খুনের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। দু-একটি ঘটনা ছাড়া প্রায় সব ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।’
নারী ও শিশু নির্যাতন শ্রেণিতে ডিএমপি ধর্ষণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ এবং অন্যান্য নারী ও শিশু নির্যাতনের অপরাধকে ফেলেছে। দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে এ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে ২ হাজার ১২টি, যা আগের বছরের চেয়ে ৫০টি কম। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৯৭টি, যা আগের বছরের চেয়ে ১৯টি কম।
অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক মনে করেন, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় সহজে বিচার শেষ হয় না। এ কারণে মানুষ মামলা করে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকে নারী ও শিশুদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে।
২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদকসংশ্লিষ্ট অপরাধে। ২০২২ সালে মাদকের মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ৩৫টি, যা মোট মামলার ৫৬ শতাংশ।