সরকারি চাকরি করতেন গিয়াস উদ্দিন। বেতনের টাকা থেকে কিছু কিছু করে জমিয়ে ১০ বছর আগে প্রায় ৬ লাখ টাকা আমানত রাখেন আহমেদীয়া ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভে। শুরুতে এক লাখে মাসে দুই হাজার টাকা মুনাফা পেতেন গিয়াস উদ্দিন। পরে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে আরও ২৫ লাখ টাকা সেখানে আমানত রাখেন তিনি। প্রথম চার থেকে পাঁচ বছর মুনাফার টাকা পেয়েছেন। কিন্তু চার বছর ধরে পাচ্ছেন না। আসল টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না তিনি।
গিয়াস উদ্দিন আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজের জমানো ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে প্রায় ২৫ লাখ টাকা জমা রেখেছিলাম। টাকা ফেরত দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি। এখন পেনশনের টাকা থেকে আত্মীয়স্বজনের ধারের টাকা পরিশোধ করছি।’ এখন সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতেও বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান অবসরপ্রাপ্ত এই সরকারি কর্মকর্তা। তিনি জানান, আদালতে মামলা করেছেন কিন্তু তাতে টাকা ফেরত পাচ্ছেন না।
গিয়াস উদ্দিনের মতোই লাখে দুই হাজার টাকা মুনাফা পাওয়ার আসায় আহমেদীয়া ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভে ৮১ লাখ টাকা আমানত রাখার কথা জানিয়েছেন মিরপুরের বাসিন্দা মাহমুদা রহমান। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামী বিদেশে ছিলেন। তাঁর পাঠানো প্রায় সব টাকা সেখানে আমানত রেখেছি। চার বছর ধরে কোনো টাকাই দিচ্ছে না প্রতিষ্ঠানটি।’
এই দুজনের মতো প্রায় ১ হাজার ১০০ গ্রাহক ২০০৬ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা আমানত রেখেছেন বলে ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মনির আহমেদ গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে নিজের ও স্ত্রী সকিনা আহমেদের নামে সম্পদ করেছেন। এই কাজে তাঁদের সহযোগিতা করেছেন সাইফুল ইসলাম নামের একজন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ছিলেন। তিনজনের বিরুদ্ধে ঢাকার কাফরুল থানায় গত রোববার মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডি মনির ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শেষে এই মামলা করেছে বলে জানিয়েছেন কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুকুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিআইডির বাইরে অনেক গ্রাহকও বাদী হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সেগুলো তদন্তাধীন রয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গ্রাহকের টাকা দিয়ে মনির আহমেদ নিজের নামে কাফরুলে ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ জমি কিনে ইউরো স্টার টাওয়ার নামের একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১১ কাঠার ৩টি প্লটও রয়েছে তাঁর নামে।
সিআইডি বলছে, গ্রাহকের টাকায় নিজের ও স্ত্রীর নামে চারটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন মনির আহমেদ। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে আহমেদ ডেভেলপার লিমিটেড, আহমেদীয়া অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপার প্রাইভেট লিমিটেড, ইউরো স্টার হোম অ্যাপলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি ও ইউরো স্টার ল্যান্ড ডেভেলপার লিমিটেড। এ ছাড়া মনির ও তাঁর স্ত্রীর নামে ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে গ্রাহকদের বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি। বর্তমানে অ্যাকাউন্টগুলোয় কোনো টাকা নেই।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নথিপত্র পর্যালোচনায় মনির ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের ৫৮ কোটি টাকা দিয়ে নিজেদের নামে সম্পদ কেনার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা বলছেন, প্রায় ১ হাজার ১০০ গ্রাহক প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা পাবেন।
মনির আহমেদ, তাঁর স্ত্রী সকিনা আহমেদ ও তাঁদের সহযোগী সাইফুল ইসলাম পলাতক থাকায় তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ওসি ফারুকুল আলম বলেছেন, তিন আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাঁদের গ্রেপ্তার করা গেলে এই প্রতারণার বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।
আজ কাফরুলে ইউরো স্টার টাওয়ারে গিয়ে আহমেদীয়া ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভের কার্যালয় বন্ধ পাওয়া যায়। ১০ তলা ওই ভবনের ৫ তলা পর্যন্ত কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংককে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাকি তলাগুলো খালি পড়ে আছে। ভবনে প্রবেশের ফটকে ঝুলছে গ্রাহকদের টাঙানো ব্যানার। সেখানে মনিরের ছবিসহ নিজেদের পাওনা টাকা ফেরতের দাবি জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকেরা।
ভবনের নিচে কথা হয় সেখানকার নিরাপত্তারক্ষী মো. মনিরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা টাকা পাবেন, তাঁদের অনেকেই প্রায় প্রতিদিনই দল বেঁধে এখানে আসেন।