ফেনী শহরের মাস্টারপাড়ার লমি হাজারী বাড়ির সামনের পুকুরের ঘাটকে স্থানীয় লোকজন ‘ঘাটলা’ বলেন। ওই ঘাটলায় বসেই ১৩ বছর ফেনী ‘শাসন’ করেছিলেন ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী।
নিজ বাড়ির সামনে পুকুরঘাটে টেবিল নিয়ে বসে তিনি ঠিকাদারি কাজ বণ্টন থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতের চাঁদাবাজির হিসাব, দলীয় ও স্থানীয় বিবাদ মীমাংসাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সকাল থেকেই জেলার বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ ঘাটলার সামনে অপেক্ষায় থাকতেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে নিজাম হাজারীর ‘ঘাটলার শাসনের’ অবসান হয়। নিজাম হাজারী ও তাঁর অনুসারীরা ফেনী ছেড়ে পালিয়েছেন। এরপর থেকে নিজামের পৈতৃক বাড়ি লমি হাজারীর বাড়ির ওই ঘাটলায় সুনসান নীরবতা। তবে তাঁর ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা ধরা না পড়ায় এখনো এলাকার মানুষ নিজামের অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পান।
নিজ বাড়ির সামনে পুকুরঘাটে টেবিল নিয়ে বসে তিনি ঠিকাদারি কাজ বণ্টন থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতের চাঁদাবাজির হিসাব, দলীয় ও স্থানীয় বিবাদ মীমাংসাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সকাল থেকেই জেলার বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ ঘাটলার সামনে অপেক্ষায় থাকতেন।
ফেনীতে সরজমিনে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১১ সালে ফেনী পৌরসভার মেয়র হওয়ার মধ্য দিয়ে নিজামের উত্থান শুরু। ২০১২ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর ফেনীর অঘোষিত ‘শাসক’ হয়ে ওঠেন। অনুগত ক্যাডারদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন।
নিজাম হাজারীর গডফাদার হয়ে ওঠার সময়ে ফেনীতে তাঁর কাছাকাছি প্রভাবশালী নেতা ছিলেন ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক। দুজনের একসময়কার গুরু জয়নাল হাজারীকে কোণঠাসা করে দলীয় ক্যাডার বাহিনীকে সংগঠিত করতে একরাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরে একরামকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে দলে ও সরকারি উন্নয়নকাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন নিজাম।
ফেনীতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দুই বছর কর্মরত ছিলেন, এমন একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ফেনীর সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি, বৈধ-অবৈধ বালুমহালের নিয়ন্ত্রণসহ পুরো জেলার অপরাধজগৎ নিজাম হাজারী নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। তাঁর সম্মতি ছাড়া অন্যদের কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া যেত না।
নিজাম হাজারীর গডফাদার হয়ে ওঠার সময়ে ফেনীতে তাঁর কাছাকাছি প্রভাবশালী নেতা ছিলেন ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক। দুজনের একসময়কার গুরু জয়নাল হাজারীকে কোণঠাসা করে দলীয় ক্যাডার বাহিনীকে সংগঠিত করতে একরাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরে একরামকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
নিজাম হাজারী ও তাঁর সহযোগীদের সর্বশেষ অপকর্মটি ছিল, গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ফেনীতে নির্বিচার গুলি করে ৯ জনকে হত্যা করা। ওই দিন সকালে নিজাম হাজারী নিজে দলীয় ক্যাডারদের নিয়ে আন্দোলন দমাতে রাস্তায় নামেন। দুপুরের দিকে তাঁর ক্যাডাররা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্যাডার বা অস্ত্রধারী ধরা পড়েননি।
ফেনী জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এসপি হিসেবে যোগ দিয়েছি এক সপ্তাহ হয়েছে। যেসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নিয়েছে, তাদের পরিচয় শনাক্ত করার কাজ চলমান আছে। এখন পর্যন্ত হামলার ঘটনায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একটি ১২ বোরের শটগান, একটি পিস্তল ও একটি একনলা বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে।’
৫ আগস্ট দুপুরের দিকে নিজাম হাজারী বাড়ির সামনের ওই পুকুরঘাটেই ছিলেন। শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবর জানাজানি হওয়ার পরপর তিনিও পালিয়ে যান। এলাকায় প্রচার আছে, তিনি বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরপর বিক্ষুব্ধ লোকজন প্রথমে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে, তারপর ‘ঘাটলা’ সংলগ্ন সাততলা বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর পৈতৃক বাড়ির অদূরে নির্মিত নিজামের বাগানবাড়িতে চলে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
নিজাম হাজারী ও তাঁর সহযোগীদের সর্বশেষ অপকর্মটি ছিল, গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ফেনীতে নির্বিচার গুলি করে ৯ জনকে হত্যা করা। ওই দিন সকালে নিজাম হাজারী নিজে দলীয় ক্যাডারদের নিয়ে আন্দোলন দমাতে রাস্তায় নামেন। দুপুরের দিকে তাঁর ক্যাডাররা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকেন। এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্যাডার বা অস্ত্রধারী ধরা পড়েননি।
উঁচু প্রাচীরঘেরা বিলাসবহুল এই বাগানবাড়ি নিয়ে ফেনীর মানুষের ছিল ব্যাপক কৌতূহল। এখানে কেবল নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠজনদেরই সেখানে যাতায়াত ছিল। সরকার পতনের এক সপ্তাহ পরও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষ এসেছে বাড়িটি দেখতে।
বাড়িটির ভেতরে ছিল হেলিপ্যাড, টেনিস কোর্ট, পুল, থিয়েটার, আঙিনায় সুসজ্জিত বাগান, ঝরনা ও বড় সুইমিংপুল। প্রচার আছে, বাড়ির মেঝেতে ব্যবহৃত মার্বেল এসেছে ইতালি থেকে। আসবাব আনা হয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও তুরস্ক থেকে।
স্থানীয় লোকজন জানান, জৌলুশপূর্ণ বিশাল এই বাগানবাড়ির পেছনে রয়েছে বহু মানুষের কান্না। নিজাম হাজারী এখানকার জমি স্থানীয়দের কাছ থেকে অনেকটা জোর করে নিয়েছেন। কেউ কেউ নামমাত্র মূল্য পেয়েছেন, আবার কেউ কেউ সেটাও পাননি। জমির মালিকদের মধ্যে নিজাম হাজারীর আত্মীয়ও ছিলেন। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের জমিও সেখানে ছিল।
প্রচার আছে, বাড়ির মেঝেতে ব্যবহৃত মার্বেল এসেছে ইতালি থেকে। আসবাব আনা হয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও তুরস্ক থেকে।
যাঁদের জমি নিয়ে বাগানবাড়ি তৈরি করেছেন, তাঁদের মধ্যে ছয়জনের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁদের মধ্যে নিজাম হাজারীর এক আত্মীয় প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রায় দেড় বিঘা জমি দখল করেছেন নিজাম হাজারী। বাগানবাড়ি নির্মাণের পর অনেকটা বাধ্য হয়ে নিজাম হাজারীর সঙ্গে আপস করেছেন তাঁরা। পরে নামমাত্র মূল্যের বিনিময়ে জমি লিখে দেন। কিছু জমি এখনো লিখে দেননি তাঁরা।
চারজন পাওয়া গেছে, যাঁরা জমি হারিয়ে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁরা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
আমি এসপি হিসেবে যোগ দিয়েছি এক সপ্তাহ হয়েছে। যেসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নিয়েছে, তাদের পরিচয় শনাক্ত করার কাজ চলমান আছে। এখন পর্যন্ত হামলার ঘটনায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একটি ১২ বোরের শটগান, একটি পিস্তল ও একটি একনলা বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছেফেনী জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান
ফেনী সদর উপজেলার বালিগাঁও ইউনিয়নের বড়ুয়ারচর, সুন্দরপুর ও ডোমরায় প্রায় ২৫ একর জমি জোর করে নিয়েছেন নিজাম হাজারী। মসজিদ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম করে এসব জমি দখল করা হয়। সেখানে গিয়ে ১০ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। একজন ছাড়া অন্যরা ভয়ে নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। এমন একজন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের পরিবারের প্রায় আড়াই বিঘা জমি দখল করেন নিজাম হাজারীর লোকজন। পরে তাঁরা সেই জমি লিখে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
শেখ জাহিদ হোসেন নামের একজন ভুক্তভোগী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রায় দুই বিঘা জমি দখল করেন নিজাম হাজারী।
একজন প্রবাসী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেছেন, নিজাম হাজারীর লোকজন তাঁর পরিবারের প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমি দখল করেছেন। সেই জমি লিখে দিতে তাঁকে মুঠোফোনে অনেকবার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তিনি ভয়ে পাঁচ বছর ধরে দেশে আসেন না।
বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি), পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, পৌরসভাসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন প্রকল্পের কোন কাজ কে পাবেন, সেটাও ঠিক করে দিতেন নিজাম হাজারী। তাঁকে প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন কাজ শুরুর আগেই দিতে হতো। উন্নয়নকাজের দরপত্র বণ্টন ও কমিশন আদায়ের দায়িত্ব ছিল ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল।
সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে ফেনী জেলায় ৬ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ১ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হয়েছে। ১০ শতাংশ কমিশন ধরলেও কেবল এসব প্রকল্প থেকেই ৬০০ কোটি টাকা আদায় করেছেন নিজাম হাজারী।
অবশ্য ফেনী জেলা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ আল ফারুক দাবি করেন, তাঁদের সব দরপত্র অনলাইনে জমা দিতে হয়। এখানে যোগসাজশের কোনো সুযোগ নেই। আর নিজাম হাজারীর কমিশন আদায়ের বিষয়টা তিনিই (নিজাম) বলতে পারবেন।
নিজাম হাজারী ও শুসেন চন্দ্র শীল পলাতক। এসব বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে চেষ্টা করা হয়। দুজনের মুঠোফোন বন্ধ। দুজনকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হয়। এর মধ্যে শুসেন চন্দ্র গত রাতে হোয়াটসঅ্যাপে কল করে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশির দশকের শেষ দিকে নিজাম হাজারী ছিলেন চট্টগ্রামের একজন অস্ত্রধারী ক্যাডার। ওই সময় তিনি চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী ছিলেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, ফেনীতে বৈধ বালুমহাল ছিল আটটি। এখন বৈধ বালুমহাল আছে তিনটি।
তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগপর্যন্ত অন্তত ৩০টি বালুমহাল থেকে বালু উত্তোলন করা হতো। এই খাতের আয়ের একটা অংশ পেতেন নিজাম হাজারী। এর মধ্যে নিজাম হাজারীর হয়ে ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফেনী নদীর বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন হায়দার চৌধুরী ওরফে সোহেল ও তাঁর ছোট ভাই রফিকুল হায়দার চৌধুরী। পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন পরশুরাম পৌরসভার মেয়র নিজাম উদ্দিন ওরফে সাজেল। ফুলগাজী এলাকার বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন ওই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার। লেমুয়া ও মুহুরীগঞ্জ বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ করতেন ফাজিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবুল হক (রিপন)। সোনাগাজী এলাকার বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক পৌর মেয়র রফিকুল ইসলাম (রতন)।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অভিষেক দাশ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অল্প কয়েক দিন আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। বালুমহালের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তাঁর জানা নেই।
পরিবহন খাতের মধ্যে চাঁদাবাজির একাংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ আলী। আর বাসস্ট্যান্ডের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন ফেনী পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম ওরফে স্বপন মিয়াজি। শহরে ফুটপাতের চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজির অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন জেলা যুবলীগের কোষাধ্যক্ষ সাইফুদ্দিন ওরফে জিতু ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি জিয়াউদ্দিন বাবলু।
তাঁদের সবাই এখন পলাতক। দলীয় নেতাদের এসব অপকর্মের বিষয়ে কথা বলার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাফেজ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, তিনি অসুস্থ। এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আশির দশকের শেষ দিকে নিজাম হাজারী ছিলেন চট্টগ্রামের একজন অস্ত্রধারী ক্যাডার। ওই সময় তিনি চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নেতা আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী ছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তিনি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামে ছিনতাইসহ অন্তত আটটি মামলা ছিল।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ফেনীর তৎকালীন গডফাদার হিসেবে পরিচিত জয়নাল হাজারীর দলে যোগ দেন নিজাম। জয়নাল হাজারী তাঁকে দিয়ে সোনাগাজী উপজেলা বিএনপিমুক্ত করান। একপর্যায়ে তিনি জয়নাল হাজারীর গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডার হয়ে ওঠেন।
২০০০ সালে দুটি অস্ত্র মামলার একটিতে ১০ বছর এবং অন্যটিতে ৭ বছর সাজা হয়েছিল নিজাম হাজারীর। এই দুটি অস্ত্র মামলায় তাঁকে ১০ বছর সাজা খাটতে হতো। জালিয়াতি করে ২ বছর ১০ মাসের সাজা কম খেটে তিনি ২০০৫ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হন।
সাজা কম খেটে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে ২০১৪ সালের ১০ মে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে তখন নিজাম হাজারীর সংসদ সদস্যপদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ফেনী জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া। হাইকোর্টের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ একটি প্রতিবেদন দেয়। তাতে উল্লেখ ছিল, নিজাম হাজারী ২ বছর ৬ মাস ১৬ দিন সাজা কম খেটে বেরিয়ে যান।
ফেনী জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন নিজাম হাজারী। এ ধরনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি সাজা খেটে মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে সংসদ সদস্য হতে পারেন না। নিজাম হাজারী জালিয়াতি করে দুই বছরের বেশি সময়ের সাজা না খেটে বেরিয়ে যান। জালিয়াতি ধরা পড়ার পরও নিজাম হাজারীর সংসদ সদস্য পদ বহাল ছিল।
ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ফেনী পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম ওরফে স্বপন মিয়াজীর দীর্ঘদিনের সখ্য। নজরুল ইসলামের মাধ্যমেই ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে নিজামের। গত ১০ বছরে ওবায়দুল কাদের যতবার ফেনীতে এসেছেন, নিজাম হাজারীর আতিথেয়তা নিয়েছেন।
২০১২ সাল পর্যন্ত নিজাম হাজারী দলীয় কোনো পদে ছিলেন না। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপর জয়নাল হাজারী দেশ ছেড়ে পালান। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগ দিয়ে নিজাম হাজারী ফেনীতে দলীয় ক্যাডারদের সংগঠিত করেন। ২০১১ সালে তিনি দলীয় মনোনয়নে ফেনী পৌরসভার মেয়র হন। ওই নির্বাচনে জালভোট, কেন্দ্র দখলসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। এর এক বছর পর ২০১২ সালের ডিসেম্বরে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৪ সালে বিনা ভোটের নির্বাচনে তিনি ফেনী-২ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রথম আলোকে জানান, নিজাম হাজারীর ‘অবিশ্বাস্য উত্থানের’ পেছনে শুরুতে শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা আলাউদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর (নাসিম) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচনী এলাকা নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ)। ফেনী সদর থেকে কোম্পানীগঞ্জের দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। এলাকায় এলে তিনি রাতযাপন করতেন ফেনীতে। ফেনীতে তাঁর সব ধরনের আমোদ ও বিলাসের ব্যবস্থা করতেন নিজাম হাজারী। ওবায়দুল কাদের–ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে নিজাম হাজারী আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন।
ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ফেনী পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম ওরফে স্বপন মিয়াজীর দীর্ঘদিনের সখ্য। নজরুল ইসলামের মাধ্যমেই ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে নিজামের। গত ১০ বছরে ওবায়দুল কাদের যতবার ফেনীতে এসেছেন, নিজাম হাজারীর আতিথেয়তা নিয়েছেন। আগে ফেনী সার্কিট হাউস এবং শহরের কুসুমবাগে এক ব্যবসায়ীর বাগানবাড়িতে উঠতেন ওবায়দুল কাদের। তবে সর্বশেষ দুই বছর ধরে মাস্টারপাড়ায় নিজাম হাজারীর বাগানবাড়িতে এসে উঠতেন ওবায়দুল কাদের।
ফেনীতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দুর্বৃত্তায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার বিশিষ্ট নাগরিক ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের চিত্র সারা দেশে একই ছিল। ফেনীতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও জনপ্রতিনিধি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তিনি বলেন, যাঁরা দুর্বৃত্তায়ন করেছেন, যাঁরা স্বচ্ছ ছিলেন না, তাঁরা ফেনী ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁদের অপকর্মের কারণে এখন নিরীহ অনেক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ভুক্তভোগী হচ্ছেন।