অজ্ঞাতপরিচয় ‘দুর্বৃত্তদের’ হাতে খুন হন গাজীপুরের শ্রীপুরের এক অটোরিকশা গ্যারেজের মালিক গিয়াসউদ্দিন (৬০)। এ ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেন গিয়াসের বড় ছেলে অলিউল্লাহ। তিন বছর পর জানা গেছে, চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে পরিকল্পনা করে গিয়াসকে হত্যায় জড়িত ছিলেন তাঁরই আরেক ছেলে।
শ্রীপুরের ভাংনাহাটির নতুন বাজারের বাসিন্দা গিয়াসের বাড়ির পাশেই অটোরিকশার গ্যারেজ। সেখানে ভাড়ায় অটোরিকশা রাখা হতো। গিয়াস রাতে গ্যারেজেই ঘুমাতেন। ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর সেখানে ঘুমিয়েছিলেন গিয়াস। পরদিন সকালে গ্যারেজ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিল না। তবে এজাহারে গিয়াসের প্রতিবেশী মো. শাহাবুদ্দিন, তাঁর ছেলে মোখলেছ ও স্ত্রী মোরশেদাকে সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মামলার বিবরণে বলা হয়, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল গিয়াসের।
শ্রীপুর থানা ও গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) মামলার তদন্ত করে। গোয়েন্দা পুলিশ হত্যার কারণ উদ্ঘাটন ও জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্ত করে পিবিআই জানতে পারে, গিয়াসকে খুন করেন তাঁরই এক ছেলে ও ভাতিজা।
মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন শ্রীপুর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আনোয়ার হোসেন। বর্তমানে তিনি কালিয়াকৈর থানায় কর্মরত। গত শনিবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হত্যায় জড়িত অভিযোগে পিবিআই যাঁকে গ্রেপ্তার করেছে, তিনিও তাঁকে সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু মামলার বাদী ও নিহত গিয়াসউদ্দিনের বড় ছেলে অলিউল্লাহর আপত্তির কারণে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি।
২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় আড়াই মাস মামলাটি তদন্ত করে শ্রীপুর থানা ও গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পিবিআইয়ের গাজীপুর জেলা মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায়।
মামলার সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. হাফিজুর রহমান। এখন তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) কর্মরত।
হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সন্দেহভাজন শাহাবুদ্দিন ও মোর্শেদার মুঠোফোনের সিডিআর (কল রেকর্ড) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘটনার রাতে তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে জয়দেবপুরে ছিলেন। ফলে এই খুনের ঘটনায় তাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
তদন্তে নেমে ফরিদ (৪৫) ও সোহেল (২৫) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। অলিউল্লাহর ফুফুর বাসায় ভাড়া থাকতেন তাঁরা। ফুফু খুনের মামলার আসামি হওয়ায় অলিউল্লাহর সন্দেহ ছিল এই দুই ব্যক্তি তাঁর বাবার হত্যাকাণ্ডেও জড়িত। তবে তদন্তে হত্যায় তাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
পুলিশ পরিদর্শক হাফিজুর বলেন, তদন্তের এক পর্যায়ে জানতে পারেন, ওই রাতে গ্যারেজ থেকে একটি রিকশা ও পাঁচটি রিকশার ব্যাটারি চুরি হয়। ঘটনার পরদিন গিয়াসের বাসার পরিবারের সদস্যদের সবার কক্ষ খোলা থাকলেও তাঁর এক ছেলে আবু জরের কক্ষটি বাইরে থাকা ছিটকিনি লাগানো ছিল। তখন আবু জর ভেতরেই ছিলেন। এসব সন্দেহ সামনে রেখে তদন্ত করতে থাকেন।
চুরি হওয়া রিকশাটির চালক মো. আলমকে ময়মনসিংহ থেকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মো. আরাফাত নামের আরেক রিকশাচালককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
যেভাবে খুন করা হয়
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলার পারিপার্শ্বিকতা, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও সাক্ষ্যপ্রমাণে জানা যায়, গিয়াসের ছেলে আবু জর নেশাগ্রস্ত। তিনি তাঁর বাবার রিকশা গ্যারেজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। নেশা করার টাকা না পেয়ে তিনি তাঁর বাবার টাকা চুরি করতেন। এ নিয়ে গিয়াসের সঙ্গে আবু জরের প্রায়ই ঝগড়া হতো। এ কারণে আবু জুর বাবার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
এ সুযোগ ‘কাজে লাগান’ গিয়াসের ভাতিজা নুরুল ইসলাম। পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ থাকায় প্রতিবেশী শাহাবুদ্দিনদের ফাঁসাতে নেশাগ্রস্ত আবু জরের সঙ্গে চাচা গিয়াসকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি।
গিয়াসের গ্যারেজে রিকশা রাখতেন দুই আসামি আলম ও আরাফাত। নুরুল ইসলাম ও আবু জর তাঁদের বলেন, গিয়াসকে হত্যা করে শাহাবুদ্দিন ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ফাঁসানো হবে। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। বিষয়টি গোপন রাখতে তাঁদের শপথও করান নুরুল ও আবু জর।
আলম, আরাফাত, কাজিমউদ্দিন নামের একজনসহ তিনজনকে নিয়ে ঘটনার রাতে গ্যারেজে ঢোকেন আবু জর ও নুরুল। গ্যারেজে ঢুকেই চাপাতি দিয়ে ঘুমন্ত গিয়াসের মাথায় আঘাত করেন আলম। যাওয়ার সময় আলম পাঁচটি অটোরিকশা থেকে ব্যাটারি খুলে নিজের রিকশায় নিয়ে যান।
গিয়াস হত্যা মামলায় আবু জুর (৩০), নুরুল ইসলাম (২৮), কাজিমউদ্দিন (৪০), আলম (৩৮) ও আরাফাতকে (২৬) আসামি করে পিবিআই সম্প্রতি অভিযোগপত্র দেয়। আলম ও আরাফাত বর্তমানে কারাগারে আছেন। আবু জর, নুরুল ইসলাম ও তাঁদের সহযোগী কাজিমউদ্দিন পলাতক।
মামলার বাদী অলিউল্লাহ তাঁর ছোট ভাই আবু জুরকে গিয়াস হত্যা মামলা থেকে বাঁচাতে মামলার তদন্ত অন্য কোনো সংস্থাকে দিয়ে করাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে আবেদন ও তদবির করেছিলেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশপ্রধান তা আমলে নেননি।
অলিউল্লাহ শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মনে করেন, তাঁর ভাই আবু জর বাবা হত্যায় জড়িত নন। এ কারণেই তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির কাছে আবেদন করেছিলেন।