নিখোঁজ হওয়ার দুদিন পর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূরের (পরশ) লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তাঁর একজন ছেলেবন্ধু ও এক বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। সোমবার বিকেলে লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলের পেছনে নদী থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ বলছে, ফারদিন নূরকে কেউ হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছে, নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি তারা। মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটনে ফারদিনের এক ছেলেবন্ধু ও এক বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাঁর বান্ধবী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। চার বছর ধরে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, ফারদিনের লাশ উদ্ধারের পর নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন গত শনিবার থেকে নিখোঁজ ছিলেন। ওই দিনই রাজধানীর রামপুরা থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তাঁর বাবা কাজী নূর উদ্দিন। এতে বলা হয়, গত শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে ফারদিন নূর পরশ রাজধানীর ডেমরা থানার কোনাপাড়ার বাসা থেকে বুয়েটে তাঁর আবাসিক হলের উদ্দেশে বের হন। পরদিন শনিবার সকালে তাঁর পরীক্ষা ছিল। তবে তিনি পরীক্ষায় অংশ নেননি। তাঁর মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ফারদিনের বাবা জিডিতে আরও লেখেন, তিনি পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, ফারদিন তার এক মেয়েবন্ধুর সঙ্গে রিকশায় রামপুরা গিয়ে নেমে যায়। তারপর বাসায় ফেরেনি।
রামপুরা থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, ফারদিন নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর এক মেয়ে ও এক ছেলেবন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, নিখোঁজের দিন ফারদিনের মুঠোফোনের শেষ অবস্থান ছিল ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকায়। পুলিশ সিসি ক্যামেরার কয়েকটি ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করেছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। ওসি আরও বলেন, ফারদিন কেরানীগঞ্জে কীভাবে গিয়েছিলেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ফারদিন নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর বাবার করা জিডি তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন বিকেলে পরশ রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করেন। সেখান থেকে রিকশায় করে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যান। ওই বান্ধবীর ভাষ্যমতে, টিএসসি থেকে তাঁরা রিকশায় রামপুরা আসেন। তবে পুলিশ ওই দিন ফারদিনের রামপুরা আসার কোনো তথ্য পায়নি।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ফারদিন নিখোঁজ হওয়ার পর একটি প্রতারক চক্র তাঁর বাবাকে বিশেষ কায়দায় ফারদিনের মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করে কল দিয়ে টাকা চেয়েছিল। এ ধরনের কলকে ‘ফিশিংকল’ বলা হয়। প্রতারক চক্রের কাছ থেকে ফোন পাওয়ার বিষয়টি তিনি পুলিশকে জানান। পরে পুলিশের তদন্তে জানা যায়, একটি প্রতারক দল রাজধানীর শাহজাদপুর থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফারদিনের বাবার মুঠোফোনে কল দিয়েছিল।
ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন বিজনেস পত্রিকা ‘দ্য রিভারাইন’–এর সম্পাদক ও প্রকাশক। ফারদিনের মা ফারহানা ইয়াসমিন গৃহিণী। তাঁদের গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা উপজেলায়। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ফারদিন। তাঁর মেজ ভাই আবদুল্লাহ্ নূর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। ছোট ভাই তামিম নূর এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
পড়াশোনায় মেধাবী ফারদিন এসএসসি ও এইচএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ–৫ পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন। গবেষণায় আগ্রহ ছিল তাঁর। ফারদিন নিজের ইচ্ছায় বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন বলে জানান তাঁর বাবা নূর উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ওরে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করতে দিয়েছি। যেহেতু আমি সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলাম, তাই খুব একটা সচ্ছল ছিলাম না, ফারদিন নিজে টিউশনি করত। নিজের পড়াশোনা, পড়ানো, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসা–যাওয়া ও সামাজিক কর্মকাণ্ড করত।’
নূর উদ্দিন জানান, তাঁর ছেলের কাছে একটি দামি মুঠোফোন, ঘড়ি ও মানিব্যাগ ছিল। সেগুলোর কিছুই খোয়া যায়নি।