১৩ বছর বয়সী কল্পনার সামনের চারটি দাঁত ভাঙা। হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাঁকার ক্ষত। কোনো কোনো ক্ষত শুকিয়ে টান ধরেছে। কোনো কোনো ক্ষত এখনো দগদগে। বুক, পিঠসহ সারা শরীরে মারের চিহ্ন। একদিকে মারধর, অন্যদিকে রক্তশূন্যতা। শারীরিক সমস্যার সঙ্গে মানসিক ট্রমা তো আছেই।
কল্পনা রাজধানীতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এক বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত। সাড়ে চার বছর ধরে সে এই বাসায় কাজ করত। বর্তমানে কল্পনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।
আজ রোববার কল্পনার শারীরিক ও মানসিক ট্রমার কথা এভাবেই বর্ণনা করলেন বার্ন ইউনিটের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন। শনিবার থেকে এই চিকিৎসকের অধীনেই ভর্তি আছে কল্পনা।
নাসির উদ্দীন জানালেন, মেয়েটির সারা শরীরে ক্ষত। তাই সংক্রমণ এড়াতে ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে। শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো হলে মঙ্গলবার প্রাথমিকভাবে একটি অস্ত্রোপচার করার সম্ভাবনা আছে। এরপর আরও অস্ত্রোপচার লাগবে। মানুষের ভিড় থেকে দূরে রাখতে এবং চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের দন্ত বিভাগ, মানসিক বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেয়েটির চিকিৎসা করতে হবে।
বেসরকারি চ্যানেল ৭১ টেলিভিশন একটি ভিডিও ফুটেজ থেকে কল্পনার বিষয়টি জানতে পারে। পরে চ্যানেলটির সাংবাদিক ইশতিয়াক ইমনের মাধ্যমে ভাটারা থানার পুলিশের সহায়তায় গতকাল শনিবার রাতে বসুন্ধরার ওই বাসা থেকে কল্পনাকে উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয় বাসার মালিক তরুণী দিনাত জাহানকে।
৭১ টেলিভিশনের প্রতিবেদনে কল্পনা অভিযোগ করেন, দীর্ঘদিন ধরে তাকে মারধর করার পাশাপাশি দিনে এক বেলা খাবার দেওয়া হতো। চুল সোজা করার যন্ত্র দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হতো তাকে। লম্বা বেত দিয়ে মারধর করা, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়া এবং বন্দী করে রাখা হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছে কল্পনা।
কল্পনারা পাঁচ বোন ও এক ভাই। আজ মুঠোফোনে কথা হয় কল্পনার মা আফিয়া বেগমের সঙ্গে। তাঁর স্বামী শরিফ মিয়া কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। তাঁরা থাকেন সিলেটের হবিগঞ্জে। মেয়েকে মারধরের অভিযোগে আফিয়া আজ বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০২০) এর অধীনে ভাটারা থানায় দিনাত জাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
আফিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে মেয়েকে ওই বাসায় কাজে দিয়েছিলেন। দিনাত জাহানের মা–বাবার সঙ্গে কথা বলেই মেয়েকে কাজে দেন। এক মাস আগে দিনাত জাহানকে ফোন দিলে তিনি বসুন্ধরা না, গুলশানে থাকেন (একা) বলে জানান। বাসায় গিয়ে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে দিনাত জাহান বাসায় যাওয়া যাবে না এবং মেয়ে ভালো আছে বলেও জানান। মেয়েও ভয়ে টেলিফোনে নির্যাতনের কথা বলতে পারেনি।
এই মা বললেন, ‘এক মাস আগেই মনে হয় দাঁত ভাইঙ্গা দিছিল। তাই মাইয়্যা কথাও কইতে পারতেছিল না। এখন দেখি মাইয়্যারে সারা শরীরে ছ্যাঁকাও দিছে। আমার কলিজাডা ফাইট্যা যাইতেছে। এইটা কোনো কারবার হইছে? আমি উপযুক্ত বিচার চাই।’
কল্পনার বোনের স্বামী হৃদয় ইসলাম গাজীপুরের চন্দ্রায় অটোরিকশা চালান। হাসপাতালে কল্পনাকে দেখতে এসেছেন। বললেন, ‘কল্পনার অবস্থা তো খুবই গুরুতর। চারটি দাঁত নাই। ওরে দেইখ্যা নিজেদেরই কষ্ট লাগতেছে।’
ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মেয়েটির মা বাদী হয়ে মামলা করেছেন। আসামিকে রিমান্ডে চাওয়া হয়েছে।
এদিকে কল্পনার সার্বিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে আজ দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। এ ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কমিশনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দেন চেয়ারম্যান। তিনি জানান, মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগ গ্রহণ করেছে এবং সরেজমিনে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, শিশুটির চিকিৎসায় হাসপাতালের পক্ষ থেকে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে।