ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় সাজা পাওয়া আসামি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীর নামে আরও দুটি মামলা চলছে। একটি মামলায় বিগত সাড়ে ছয় বছরে তাঁকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ দিন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একজন সাক্ষীও আসেনি।
রাহমানীর মতো একজন জঙ্গি নেতাকে এভাবে আদালতে আনা-নেওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি আদালত চত্বর থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
রাহমানীকে ২০১৩ সালের ১২ আগস্ট বরগুনা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ঢাকার আরেকটি আদালত। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মুফতি জসীম বলেন, প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবা দিতেন। তখন তিনি তাঁর লেখা ‘উন্মুক্ত তরবারী’ বইয়ে ইসলাম অবমাননার শাস্তির বিষয়ে বয়ান করেছেন। তিনি ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন ধরনের অপব্যাখ্যা দেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
৯ বছর আগে গোপন বৈঠক থেকে জঙ্গি নেতা রাহমানীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে ব্লগার রাজীব হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পাশাপাশি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়।
দুটি মামলায় রাহমানীসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতা, সরকার ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। মামলা দুটিতে সাক্ষী করা হয়েছে ৩১ জনকে।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, যেদিন মামলার শুনানির দিন ধার্য থাকে, সেদিন রাহমানীকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় রাহমানীসহ আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের শেষ দিকে অভিযোগ গঠন করা হয়।
সর্বশেষ ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে রাহমানীকে হাজির করা হয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন কোনো সাক্ষী হাজির হননি। কেবল এই তারিখ নয়, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই ট্রাইব্যুনালে রাহমানীকে কমপক্ষে ৫০ বার হাজির করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রপক্ষে কোনো সাক্ষী আসেননি। এ মামলায় এখন পর্যন্ত একজন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি গোলাম ছারোয়ার খান প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় জসীম উদ্দিন রাহমানীর বিরুদ্ধে সাক্ষী আসছেন না। তবে আদালত থেকে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এখন থেকে মামলার সাক্ষীদের হাজির করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে।
এ ছাড়া ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলায় সর্বশেষ গত ৩ অক্টোবর রাহমানীকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোনো সাক্ষী আসেননি। এই মামলায় সর্বশেষ সাক্ষী এসেছিলেন গত ২৯ মে।
এখন পর্যন্ত ১০ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল এই মামলায় চারজন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর তিন বছর কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির করা হয়নি। তবে ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি একজন সাক্ষী হাজির করা হয়।
সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দ্রুত বাকি সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা হবে।
গত ২০ নভেম্বর দুপুরে রাজধানীর রায়সাহেব বাজার মোড়সংলগ্ন ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আদালত ফটকের সামনে থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে সহযোগীরা ছিনিয়ে নেন। পালিয়ে যাওয়া দুই জঙ্গি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।
দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার পর আদালত এলাকায় দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। কারাগার থেকে আদালতে আসা দুর্ধর্ষ জঙ্গি আসামিদের ওপর প্রয়োজনীয় নজরদারিও ছিল না বলে আদালত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান প্রথম আলোকে বলেন, জসীম উদ্দিন রাহমানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গি নেতাকে বছরের পর বছর ধরে কারাগার থেকে আদালতে আনা হবে অথচ বিচারপ্রক্রিয়া এগোবে না, এটি দুঃখজনক ঘটনা।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের স্পর্শকাতর মামলার আসামির বিচার দ্রুত শেষ করা দরকার। এর মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার যে জঙ্গি নেতাদের বিচারে রাষ্ট্রপক্ষের যতটা গুরুত্ব দেওয়ার দরকার ছিল, সেটি দেওয়া হচ্ছে না।