এ খুনের ঘটনার ‘পরিকল্পনাকারী’ ক্ষমতাসীন দলের তিন নেতার নাম বাদ দিতে ডিবিকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ।
হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে মূল অভিযুক্ত, তাঁর সহযোগী, পরিকল্পনাকারীসহ ২৫ জন। হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র, মোটরসাইকেলও উদ্ধার হয়েছে। এরপরও তদন্ত শেষ করতে পারছে না ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাজধানীর শাহজাহানপুরে প্রকাশ্যে গুলি করে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম (টিপু) ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন হত্যার ১০ মাস হতে চলল। একে একে জামিনে বেরিয়ে আসছেন আসামিরা। এ অবস্থায় আতঙ্কে রয়েছেন জাহিদুলের স্ত্রী-সন্তানেরা।
গত বছরের ২৪ মার্চ রাজধানীর শাহজাহানপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় জাহিদুল ও কলেজছাত্রী সামিয়াকে। এ ঘটনায় জাহিদুলের স্ত্রীর ফারহানা ইসলাম শাহজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ডিবির মতিঝিল বিভাগ।
আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আল রাজীব গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে।
হত্যার ঘটনায় রাঘব–বোয়ালদের নাম আসায় তদন্ত থেমে গেছে। আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফোন দিয়ে আমাকে বলা হচ্ছে, চারজনের নাম না বলতে।ফারহানা ইসলাম, নিহত জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও বাদীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাহিদুল খুনের ঘটনার পরিকল্পনাকারী হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের
তিন নেতার নাম আসায় থমকে আছে মামলার তদন্ত। হত্যা মামলা থেকে তাঁদের নাম বাদ দিতে বিভিন্ন মহল থেকে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মামলা থেকে তিনজনকে বাদ দিতে তদবির রয়েছে। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রাজি হচ্ছেন না। তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে বাদ দিতে চান না। এ কারণে তদন্ত শেষ হওয়ার পর অভিযোগপত্র দেওয়া যাচ্ছে না।
জাহিদুল হত্যার পর রাজধানীর রাজারবাগে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে কারা জড়িত, নাটের গুরু কারা—সবকিছুই গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে নিয়ে আসা হবে। যারাই এ ঘটনায় জড়িত থাকুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
মতিঝিল এলাকার আধিপত্য, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসার জেরে জাহিদুলকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানান আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিবি ‘শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর জবানবন্দিতে মূল পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদারের (মুসা) নাম আসে।
ডিবি ওমান থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় আনার পর আদালতে জবানবন্দি দেন মুসা। জবানবন্দিতে তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মনসুর, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল শাহরিয়ার ও ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজার নাম বলেন। এঁদের মধ্যে সোহেল শাহরিয়ার, মারুফ রেজাসহ এ মামলায় পুলিশ ও র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন ২৫ আসামি। তবে অজ্ঞাত কারণে মারুফ আহমেদ ও গোলাম আশরাফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
এদিকে আদালত সূত্র জানায়, জাহিদুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার রাকিবুর রহমান, ইয়াসির আরাফাত ও ইশতিয়াক আহম্মেদ, মশিউর রহমান ও আরিফুর রহমান (‘ঘাতক’ সোহেল) জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।
এ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’ হত্যার ঘটনায় নাম আসা নিয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
জামিনে আসামি বেরিয়ে আসায় ও মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী জাহিদুলের স্ত্রী ফারহানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হত্যার ঘটনায় রাঘব–বোয়ালদের নাম আসায় তদন্ত থেমে গেছে। আমাকে ফোন দিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফোন দিয়ে আমাকে বলা হচ্ছে, চারজনের নাম না বলতে।’ ফারহানা আরও বলেন, তদন্ত শেষ হয়নি। অথচ আসামিরা একে একে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছেন। হতাশা আর আতঙ্কের মধ্যে ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিন কাটছে তাঁর।