আল-কায়েদাপন্থীদের নিয়েই এখন দুশ্চিন্তা

হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার সাত বছর পর এসে দেশে আইএসপন্থীদের তৎপরতা স্তিমিত। তবে সক্রিয় রয়েছে আল-কায়েদাপন্থী তিন সংগঠন।

রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার মধ্য দিয়ে দেশে এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল আইএস মতাদর্শী জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবি। ওই হামলার সাত বছর পর এসে ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক অনেকটাই ভেঙে গেছে।

তবে নব্য জেএমবির মতো আনসার আল ইসলামকে সেভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উল্টো এই জঙ্গিগোষ্ঠী আরেক জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) তাদের সঙ্গে এক ছাতার নিচে এসেছে বলে জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত সূত্রগুলোর কাছে তথ্য রয়েছে। জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেও আনসার আল ইসলামের সম্পর্ক থাকার কথা সামনে এসেছে।

এ কারণে আল-কায়েদাপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল ইসলামকে নিয়ে এখন সব নিরাপত্তা উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা রয়েছে বলে মনে করেন

জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধে যুক্ত ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, আনসার আল ইসলামের সঙ্গে বাকি দুটি সংগঠনের সম্পর্ক মূলত মতাদর্শকেন্দ্রিক। জেএমবি ও নতুন সংগঠন শারক্বীয়াও আল-কায়েদা মতাদর্শ অনুসরণ করে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্বীকার না করলেও জামাতুল আনসার নিজেদের আল-কায়েদার ভারত উপমহাদেশের (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা দাবি করে থাকে। সব মিলিয়ে দেশে এখন আল-কায়েদাপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীর সক্রিয়তা বেশি বলে মনে করছে এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মতে, সিরিয়ায় আইএসের (ইসলামিক স্টেট) পতনের পর সারা দুনিয়ায় এই জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রভাব কমে আসে। এর প্রভাব এ দেশের জঙ্গিদের মধ্যেও পড়েছে। তার আগে হোলি আর্টিজানের হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৫টি অভিযানে নব্য জেএমবির ৬৪ জন জঙ্গি নিহত হন। এঁদের মধ্যে সংগঠনটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায় সবাই রয়েছেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে এই গোষ্ঠী পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি।

* জেএমবি ও আনসার এক ছাতার নিচে। * শারক্বীয়ার পাহাড়ে তৎপরতার নতুন মাত্রা। * আইএসপন্থীদের নেটওয়ার্ক ভেঙে গেছে।

নিজেদের আইএস দাবি করা এই সংগঠনের নেটওয়ার্ক এখন অনেকটাই বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নব্য জেএমবির অধ্যায় প্রায় শেষ। সংগঠনটির কিছু সদস্য বা সমর্থক থাকলেও তাদের সেভাবে কোনো নেতা নেই। সাংগঠনিক ‘চেইন অব কমান্ড’ নেই। নতুন সদস্য সংগ্রহেও তেমন তৎপরতা নেই। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সদস্য রয়েছে। তারা আফগানিস্তানে সক্রিয় আইএস-খোরাসানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টায় আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

অবশ্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, জেএমবি ও নব্য জেএমবি এখন আর নেই, তবে কিছু সুপ্ত বীজ রয়েছে। নতুন কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা সারা দেশ থেকে তরুণদের পাহাড়ে নিয়ে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে। পুলিশ ও র‍্যাবের ধারাবাহিক অভিযানে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, আমরা বলব যে এটা নিয়ন্ত্রণে আছে।’

জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম

জেএমবির আমির মাওলানা সাইদুর রহমান অনেক বছর ধরে কারাগারে। তাঁর অবর্তমানে সংগঠনটির নেতৃত্ব মূলত সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিনের হাতে। ২০১৪ সালের পর তাঁর নেতৃত্বে ভারতে জেএমবির সাংগঠনিক বিস্তার ঘটেছে বলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য আছে।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে সালাহউদ্দিনের একিউআইএসের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে মতাদর্শগত মিলের কারণে আনসার আল ইসলামের সঙ্গে জেএমবি এক ছাতার নিচে আসে। আবার কারাগারে জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাসহ বেশ কজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আছেন। সেখানে উভয় সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় গড়ে উঠেছে। ধারণা করা হয়, দুই জঙ্গি সংগঠন এক জোট হওয়ায় তাদের প্রথম যৌথ হামলা ছিল ২০১৯ সালের ১১ জুন মুন্সিগঞ্জের প্রকাশক ও লেখক শাহজাহান বাচ্চু হত্যার ঘটনা।

জঙ্গিবাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, আমরা বলব যে এটা নিয়ন্ত্রণে আছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক

শাহজাহান বাচ্চু হত্যার ঘটনা বাদ দিলে আনসার আল ইসলাম সর্বশেষ হত্যাযজ্ঞ ঘটায় ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল। ওই দিন জঙ্গিরা ঢাকার কলাবাগানের বাসায় ঢুকে সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু থিয়েটারকর্মী মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে। এরপর গত সাত বছর দৃশ্যত আনসার আল ইসলামের তৎপরতা নেই। তবে সংগঠনটি অনলাইনে মতাদর্শ প্রচার ও সদস্য সংগ্রহের কাজে ব্যাপকভাবে সক্রিয় রয়েছে বলে সাইবার প্যাট্রোলিংয়ে (অনলাইনে নজরদারি) যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান। কোনো কোনো কর্মকর্তার মতে, আনসার আল ইসলাম অনেকটা ঘাপটি মেরে আছে। দেশের অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীর তুলনায় এরা সবচেয়ে সংগঠিত। এর সদস্যদের বেশির ভাগ শিক্ষিত ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। তারা সাংগঠনিক নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রমতে, আনসার আল ইসলামের নেতৃত্ব কাঠামোর ওপরের দিকে অন্তত ২৩ জন নেতা রয়েছে। তাদের একজনও গ্রেপ্তার হয়নি। তাদের অর্থের উৎসও বন্ধ করা যায়নি।

এই বিষয়ে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) উপকমিশনার এস এম নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিবাদ যেমন চলমান প্রক্রিয়া, এর নিয়ন্ত্রণও চলমান প্রক্রিয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা সরাসরি তৎপরতা তেমন চালাতে পারছে না। তারা অনলাইনে দাওয়াতি কার্যক্রম বা সদস্য সংগ্রহের তৎপরতা চালাচ্ছে। এ কারণে অনলাইনে নজরদারি বা সাইবার প্যাট্রোলিংয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

দৃশ্যপটে নতুন সংগঠন শারক্বীয়া

কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া সাত তরুণের খোঁজ করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শরক্বীয়া নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব। সংগঠনটির তৎপরতার নতুন দিক হলো, তারা শুরুই করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে আস্তানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে। ২০২১ সালে পাহাড়ে চালু করা আস্তানায় শারক্বীয়া দেশের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৫৫ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে।

নতুন এই গোষ্ঠী বেশি আলোচনায় এসেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে পাহাড়ের একটি নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সহযোগিতায় তাদের তৈরি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়ার ঘটনার কারণে। গত বছরের অক্টোবরে দুর্গম এলাকার ওই সব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান শুরু করে। কেএনএফ ও শারক্বীয়ার অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তারও করা হয়। এখন পর্যন্ত কেএনএফের গুলি ও পুঁতে রাখা বোমায় পাঁচজন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন।

পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, টাকার বিনিময়ে কেএনএফ এই জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের জোগান দিয়েছে। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে লিখিত চুক্তিও হয়েছে।

জঙ্গিবাদ যেমন চলমান প্রক্রিয়া, এর নিয়ন্ত্রণও চলমান প্রক্রিয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা সরাসরি তৎপরতা তেমন চালাতে পারছে না। তারা অনলাইনে দাওয়াতি কার্যক্রম বা সদস্য সংগ্রহের তৎপরতা চালাচ্ছে। এ কারণে অনলাইনে নজরদারি বা সাইবার প্যাট্রোলিংয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সিটিটিসির উপকমিশনার এস এম নাজমুল হক

পাহাড়ি বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে ধর্মভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর এমন সম্পর্কের কথা এর আগে জানা যায়নি, যা অনেককে বিস্মিত করেছে।

দুই ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর দুই সংগঠনের মধ্যে এই যোগসূত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটিটিসির উপকমিশনার এস এম নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার তৎপরতা, পাহাড়ে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলার ঘটনার দুই রকম তাৎপর্য রয়েছে। একটা হলো জঙ্গিবাদের বিস্তার, অপরটি ভূরাজনীতি। কুকি-চিনের মতো খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী উপজাতিদের সঙ্গে এই জঙ্গিরা কীভাবে মিলল, এর সঙ্গে আন্তদেশীয় কোনো যোগসাজশ আছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয় রয়েছে। তিনি বলেন, শারক্বীয়া আনসার আল ইসলামের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছে। তাই দুই সংগঠনের মধ্যে সম্পর্কটা কী, সেটাও তদন্ত করে দেখা হবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, জঙ্গিবাদ নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। হোলি আর্টিজানে হামলার পর ব্যাপক অভিযানে অনেক জঙ্গি নিহত হয়, জঙ্গি আস্তানা ধ্বংস করা হয়। এরপর জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে একধরনের শিথিলতা দেখা গেছে। যার সুযোগে নতুন জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। কুমিল্লার সাত তরুণ নিখোঁজ, সেই ঘটনায় থানায় জিডি; তারপর সেটা নিয়ে অনুসন্ধানে নেমে র‍্যাব নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী ও পাহাড়ে তাদের আস্তানার সন্ধান পায়। যদি বিষয়টা এভাবে জানাজানি না হতো, কয়েক বছরের মাথায় এই জঙ্গিরা ভয়ংকরভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত। যেমনটা হয়েছিল হোলি আর্টিজান জঙ্গি হামলার মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ না ম মুনীরুজ্জামানের মতে, দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা সাময়িক স্তিমিত, কিন্তু তারা নিষ্ক্রিয় নয়। তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে। এর মধ্যে নতুন মাত্রা বা নতুন আঙ্গিকে যোগ করেছে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে জঙ্গিদের যোগসাজশ। তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ দমনে আমরা যে পন্থায় এগোচ্ছি, তাতে সমাধান দেখি না। পুরো বিষয়টা পুলিশি তৎপরতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জাতীয় পর্যায়ে যে রকম কৌশল প্রণয়ন দরকার, সেটা এখানে দেখা যাচ্ছে না।’

এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের মতে, পুরো সমাজ ও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে যুক্ত করে এবং সরকারের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে উগ্রবাদ মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে। ‘ডির‌্যাডিক্যালাইজেশনের’ মতো বিশেষায়িত জাতীয় কৌশলনীতি প্রণয়ন করতে হবে। জঙ্গিদের পুনর্বাসনের কর্মসূচি নিতে হবে, কারাগার যেন জঙ্গিবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্র না হয়, সেই লক্ষ্যে কর্মসূচি নিতে হবে।