রাজধানীর হাজারীবাগে ২০২২ সালের ২৩ জুন খুন হন আকলিমান নেছা (৭০)। ভাগনে বশিরুল হকের (৫২) বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষ থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় আকলিমানের মরদেহ ম্যাট্রেসে (তোশক) ঢাকা ছিল। তাঁর হাত, মুখ ও পা বাঁধা ছিল কালো স্কচটেপে।
কে বা কারা আকলিমানকে খুন করেছে, তা এক বছরেও উদ্ধার করা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা ম্যাট্রেসে লেগে থাকা ডিএনএ নমুনার সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছেন ভাগনে বশিরুল। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আকলিমান রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে সূত্রাপুরের হেমেন্দ্র দাস সড়কে ভাই আবুল কালাম মোহাম্মদ সরোয়ারের বাসায় বসবাস করতেন। ওই বাসায় আকলিমানের দেখাশোনা করতেন ভাই সারোয়ারের ছেলে আবুল কালাম মোহাম্মদ সানোয়ার।
সেখান থেকে আকলিমান গত বছরের জুনে হাজারীবাগে বোনের ছেলে বশিরুলের বাসায় বেড়াতে যান। ওই বাসায় বশিরুলের বোন শামীমাও থাকতেন।
২৩ জুন দুপুরে সানোয়ারকে ফোন করেন শামীমা। বলেন, আকলিমান বেঁচে নেই। খবর পেয়ে সানোয়ার সূত্রাপুর থেকে হাজারীবাগে বশিরুলের বাসায় গিয়ে নিচতলার একটি কক্ষে আকলিমানের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে যে ম্যাট্রেস দিয়ে আকলিমানের মরদেহ ঢাকা ছিল, সেটি আলামত হিসেবে জব্দ করেন। পুলিশ জানায়, ওই ম্যাট্রেসের গায়ে বমি লেগে ছিল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়, সেটা সন্দেহভাজন খুনির বমি।
আকলিমান খুনের ঘটনায় ২০২২ সালের ২৩ জুন হাজারীবাগ থানায় সানোয়ার বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত শুরু করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
সন্দেহভাজন হিসেবে বশিরুল ও শামীমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাঁরা খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। পরে আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা বমির নমুনা ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয় বশিরুল ও শামীমার রক্তের নমুনাও।
গত ৩১ জুলাই পাওয়া সিআইডির ফরেনসিক প্রতিবেদন থেকে ডিবি জানতে পারে, মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা ম্যাট্রেসের গায়ে লেগে থাকা বমি বশিরুলের। আকলিমানের খুনের অভিযোগে গত মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) বশিরুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত বশিরুলকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন।
আকলিমানের খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ধানমন্ডি জোনাল টিমের পরিদর্শক তারিকুল আলম গত বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আকলিমান নেছার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বলছে, তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। বশিরুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
চারতলা ওই বাসার দ্বিতীয় তলায় থাকেন বশিরুল ও শামীমা। খুনের দিন বাসায় ছিলেন না, বলেছেন তাঁরা। পুলিশকে জানিয়েছেন, ঘটনার আগের রাতে তাঁরা এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে কোমল পানীয় পানের পর অসুস্থ বোধ করেন বশিরুল ও শামীমা। শুরুতে বশিরুল বাসায় ফিরে আসেন। কিছুটা সুস্থ বোধ করার পর শামীমাও বাসায় ফেরেন।
পুলিশকে বশিরুল ও শামীমা বলেন, কে বা কারা আকলিমানকে খুন করেছেন, অসুস্থ থাকায় তাঁরা কিছুই বুঝতে পারেননি। তাঁদের ভাষ্য, আলমারি ভেঙে ৪০ হাজার টাকা নিয়ে গেছেন হত্যাকারীরা।
ডিবি পরিদর্শক তারিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বশিরুল ও শামীমা তাঁদের আত্মীয়ের বাসায় যে কোমল পানীয় পান করেছিলেন, সেটির ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে চেতনানাশকের কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া ভাই–বোনের রক্তের নমুনাতেও চেতনানাশকের নমুনা মেলেনি। তাই অসুস্থ হওয়া এবং আকলিমানের খুনের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই না জানার দাবির সত্যতা নেই বলেই প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।
এরপর আলামত হিসেবে জব্দ করা ম্যাট্রেসে লেগে থাকা বমি বশিরুলের বলে ফরেনসিক প্রতিবেদন পাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে সন্দেহ আরও জোরদার হয়েছে।
আকলিমান হত্যা মামলার বাদী আবুল কালাম মোহাম্মদ সানোয়ার তাঁর ফুফু হত্যার কঠোর বিচার দাবি করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বৃদ্ধা ফুফুকে কে খুন করেছে, সেটা জানি না। এই খুনের দায়ে আমারই এক ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নির্মম এই খুনের পেছনে যে–ই জড়িত থাক না কেন, আমি তার শাস্তি চাই।’