বাসে ধর্ষণ-হত্যার শিকার রুপার মায়ের এখন একটাই চাওয়া

জাকিয়া সুলতানা রুপা
ছবি: সংগৃহীত

জাকিয়া সুলতানা রুপা ‘ব্যারিস্টার’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। রাজধানীর আইডিয়াল ল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করছিলেন।দিয়েছিলেন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট এই পরীক্ষা শেষে বগুড়া থেকে কর্মস্থল ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন রুপা। রাতে চলন্ত বাসে চালক, চালকের তিন সহকারীসহ পাঁচজন তাঁকে ধর্ষণ করেন। পরে তাঁরা তাঁকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকার রাস্তার পাশে ফেলে যান।

গতকাল বুধবার বিকেলে মুঠোফোনে রুপার বড় ভাই হাফিজুর রহমানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আবার সেই ২৫ আগস্ট এসেছে। রুপা নাই পাঁচ বছর হয়ে গেল। বিচারিক আদালতে রুপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতে আপিল শুনানি শুরু হয়নি। আমরা দ্রুত রায় কার্যকর চাই।’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রুপা

রুপাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশে। রুপা হত্যা মামলার বাদী তাঁর বড় ভাই হাফিজুর। তিনি বলেন, রুপার ঘটনার পর থেকে মা হাসনাহেনা বেগম মানসিক-শারীরিক, কোনোভাবেই আর ভালো নেই। তাঁর বয়স হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকতে রুপা ধর্ষণ-হত্যায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের রায় কার্যকর দেখে যেতে চান। এটাই এখন তাঁর একমাত্র চাওয়া।

রুপা ধর্ষণ-হত্যা মামলায় ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক রায় ঘোষণা করেন। রায়ে চার আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। একজনকে দেওয়া হয় সাত বছরের কারাদণ্ড।

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া চার ব্যক্তি হলেন ছোঁয়া পরিবহন বাসের চালক হাবিবুর রহমান, চালকের সহকারী শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর। সাত বছরের কারাদণ্ড পান বাসের সুপারভাইজার সফর আলী। একই সঙ্গে তাঁকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি রুপার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার আদেশ দেন আদালত। পরে আসামিরা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন।

হাফিজুর বলেন, ‘রুপা ধর্ষণ-হত্যার রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু এত দিনেও রায় কার্যকর না হওয়ায় আমাদের হতাশা বাড়ছে।’

রুপা হত্যা মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবিতে গত বছর পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধন করেন

রুপা হত্যা মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবিতে তাঁর পরিবারের সদস্যরা গত বছরের ২৫ আগস্ট সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা পরিষদসংলগ্ন শহীদ মিনার চত্বরে মানববন্ধন করেছিলেন।

ক্ষতিপূরণ হিসেবে ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি রুপার পরিবার এখনো পায়নি। হাফিজুর বলেন, বাসটি মধুপুর থানা চত্বরে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

গতকাল সন্ধ্যায় মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাজহারুল আমিন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মাস ছয় আগে এ থানার দায়িত্ব পেয়েছেন। থানা চত্বরে একটি বাস আছে। তিনি তা দেখেছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে তিনি শুনেছেন, এটি রুপার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার কথা। তবে তিনি এখনো নথিপত্র দেখেননি। খোঁজ নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারবেন।

হাফিজুর বলেন, রুপা ধর্ষণ-হত্যার ঘটনার পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে বাবা ক্যানসারে মারা যান। বাবার চিকিৎসায় তাঁদের অনেক টাকা খরচ হয়। এখন তাঁদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। রুপার ঘটনার পর তখনকার জেলা প্রশাসক তাঁর ছোট ভাই রুমান হাসানকে একটি চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন জেলা প্রশাসক এখান থেকে চলে যাওয়ার পর বিষয়টি চাপা পড়ে যায়।

রুপাই শেষ নয়

চলতি মাসের শুরুর দিকে কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা নারায়ণগঞ্জগামী যাত্রীবাহী একটি বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

ডাকাত দল বাসটি কয়েক ঘণ্টা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে যাত্রীদের মারধর ও লুটপাট চালায়। তারা বাসচালক ও তাঁর সহকারীকে বেঁধে ফেলে। পরে দেশীয় অস্ত্রের মুখে বাসের যাত্রীদের হাত, পা ও চোখ বেঁধে ফেলে তারা। একপর্যায়ে এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করে ডাকাত দল। এ ছাড়া তারা একাধিক নারী যাত্রীর শ্লীলতাহানি করে। পরে তারা বাসটিকে রাস্তার পাশে কাত করে ফেলে পালিয়ে যায়।

এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই চলতি মাসে আরেকটি ঘটনা ঘটে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলাচলকারী তাকওয়া পরিবহনের একটি মিনিবাসে। বাসের কর্মীরা ধাক্কা দিয়ে স্বামীকে ফেলে দেন। পরে বাসের পাঁচ কর্মী স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চার বছরে গণপরিবহনে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ১৩৪টি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৪২টি দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ৯১টি যৌন হয়রানির ঘটনা।

রুপার ভাই হাফিজুর বলেন, ‘ভেবেছিলাম, রুপার ঘটনাই হবে শেষ ঘটনা; কিন্তু তা হয়নি। বাসে এ ধরনের ঘটনা থামেনি। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রদানের পাশাপাশি তা দ্রুত কার্যকর করা হলে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটত না বলে আমি মনে করি।’