পারিবারিক বিরোধে শিশু হত্যা বেশি 

গত বছরে ১৬৫ শিশু হত্যার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই দেখতে পায়, পারিবারিক বিরোধ ও পূর্বশত্রুতার জেরে বেশি শিশু খুন হয়েছে। 

শিশু হত্যা

কলেজছাত্র সাজ্জাদ হোসেন ওরফে শান্ত (১৭) বছর তিনেক আগে সৎ মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় বেড়াতে গিয়ে পুকুরে নৌকাডুবিতে মারা যায়। এ ঘটনায় শ্রীনগর থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে আসে, সাজ্জাদকে মাথায় আঘাত করে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক শত্রুতার জেরে তাকে হত্যা করা হয়।

 গত সাত বছরে (২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত) সারা দেশে সাজ্জাদের মতো ১৬৫ শিশু হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই প্রমাণ পেয়েছে, শত্রুতাবশত খুনের সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে পারিবারিক বিরোধে ৩২ ও পূর্বশত্রুতার জেরে ২২ শিশু খুন হয়েছে। এ ছাড়া শিশু হত্যার আরও ২৩টি কারণ খুঁজে পেয়েছে পিবিআই।

পিবিআইয়ের প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘একেক উপজেলায় শিশু খুনের কারণ একেক রকম। শাস্তি জেনেও শিশুদের খুন করা হচ্ছে। গ্রামে বাচ্চারা সব সময় নিরাপদে থাকার কথা। এটা নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা করা গেলে পেছনের কারণগুলো বেরিয়ে আসবে।’

নৌকাডুবিতে সাজ্জাদের মৃত্যু

মামলার তদন্ত সূত্র জানায়, সাজ্জাদের মা সালমা হোসেন ওরফে চানবানু ও নয়ন মিয়ার বাবা মো. মুসা সৎভাই-বোন। সালমা ও মুসা রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় তাঁদের পৈতৃক জমিতে থাকেন। ২০২০ সালে সাজ্জাদ পুরান ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেন। মুসা ও তাঁর ছেলে নয়ন মাদকাসক্ত, এমন ধারণা থেকে সাজ্জাদকে তাঁদের সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেন সালমা। এ নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য ও পারিবারিক বিরোধ তৈরি হয়। পরে ওই বছরের ১৩ আগস্ট নয়ন ও তাঁর বন্ধু মারুফ কৌশলে সাজ্জাদকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে মাওয়া ঘাটে বেড়াতে যান। সেখান থেকে রাতে নয়ন বন্ধুসহ তাঁকে নিয়ে নানাবাড়ি যান। রাত ১২টার দিকে নানির বাড়িতে পুকুরের নৌকায় ওঠেন তিনজন। নৌকায় সাজ্জাদ ও নয়নের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। নৌকায় নয়ন ডাল দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেন। এ সময় মারুফ ধাক্কা দিয়ে সাজ্জাদকে নৌকা থেকে ফেলে দেন। তিনজনের মধ্যে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে নৌকা ডুবে যায়। সাঁতার না জানায় সাজ্জাদ পানিতে ডুবে যান। 

মুন্সিগঞ্জ পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ এমাদাদুল হক বলেন, হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে নয়ন, তাঁর নানি হেনা বেগম ও বন্ধু মারুফ নৌকাডুবি বলে প্রচার চালান। পরদিন গ্রামবাসী পুকুর থেকে সাজ্জাদের মরদেহ উদ্ধার করে ও শ্রীনগর থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। পরে সাজ্জাদের মার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করার নির্দেশ দেন।

শিশুদের নিরাপত্তায় বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন দরকার। শিশুদের কীভাবে জীবনমুখী শিক্ষা দিতে হবে, কীভাবে জীবনদক্ষতা শেখাতে হবে, সেগুলো আমরা জানি না। রাষ্ট্রকে শিশু আইনের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
এ এস এম আমানউল্লাহ, অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হত্যার আরও কারণ

পিবিআই বলছে, পারিবারিক বিরোধের পর শিশু হত্যাকাণ্ডে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পূর্বশত্রুতা। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর পূর্বশত্রুতার জেরে স্কুলছাত্র ও ভ্যানচালক শামীম শেখকে (১৪) হত্যা করে লাশ গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর বারাশিয়া নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ৫ নভেম্বর শামীমের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ ও তার বাবা আরিফ শেখ হত্যা মামলা করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোপালগঞ্জ পিবিআিইয়ের উপপরিদর্শক সাজ্জাদুল ইসলাম গত রোববার বলেন, করোনাকালে আর্থিক সংকটে শামীম শেখের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সে ভ্যান চালাতে শুরু করে। মামলার তদন্তভার পেয়ে তিনি সন্দেহভাজন হিসেবে আরেক ভ্যানচালক জিহাদ হোসেনকে গ্রেপ্তার করেন। রিমান্ডে তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে স্বীকার করে বলেন, ভ্যানচালক শাকির আলীর পরিকল্পনায় শামীমকে হত্যা করা হয়েছে। পরে শাকিরকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, কাশিয়ানীর রামদিয়া বাজারে ভ্যান চালানোর সময় শামীমের সঙ্গে শাকিরের কথা–কাটাকাটির জেরে শামীমকে হত্যা করা হয়। এ জন্য জিহাদকে ১০ হাজার টাকা দেবে বলে অগ্রিম ৫০০ টাকা দেয়। হত্যার পর শামীমের হাত–পা বেঁধে শাকির নদীতে ফেলে দেয়।

পিবিআইয়ের সমীক্ষায় দেখা যায়, শিশু হত্যায় পারিবারিক বিরোধ ও পূর্বশত্রুতার পর রয়েছে বিবাহ–বহির্ভূত সম্পর্ক ও প্রেমঘটিত কারণ। গত ৭ বছরে বিবাহ–বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে ১০ ও প্রেমঘটিত কারণে ১০ শিশু খুন হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহে খুন হয় ৯ শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১০ শিশুকে। এ ছাড়া ছিনতাইকারীর হাতে সাত ও অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলায় ছয়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে পাঁচ, খেলাধুলার জেরে পাঁচ ও কথা–কাটাকাটির জেরে পাঁচ শিশুকে হত্যা করা হয়। এর বাইরে চুরি দেখে ফেলায়, ধর্ষণ ও বলাৎকারে ব্যর্থ হয়ে, কথা না শোনায়, চোর সন্দেহে, মুক্তিপণের জন্য, ছিনতাই করার সময় বাধা, গৃহকর্ত্রী ও মাদ্রাসার শিক্ষকের হাতে এবং সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ১১টি শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।

পিবিআই সূত্র জানায়, সমীক্ষায় ১৬৫ শিশু খুনের মধ্যে ১৩২টির কারণ বেরিয়ে এসেছে। তদন্তাধীনসহ অন্যান্য কারণে ৩২ শিশু খুনের মামলার কারণ উদঘাটিত হয়নি।

রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম আমানউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের নিরাপত্তায় বিদ্যমান আইনের পরিবর্তন দরকার। শিশুদের কীভাবে জীবনমুখী শিক্ষা দিতে হবে, কীভাবে জীবনদক্ষতা শেখাতে হবে—সেগুলো আমরা জানি না। রাষ্ট্রকে শিশু আইনের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। শিশুর গায়ে হাত দিলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।