বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ, নিয়মবহির্ভূতভাবে পদে থাকার মতো বেশ কিছু অভিযোগ তুলেছেন বিটিভিরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশ। ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২১ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে নিয়মবহির্ভূতভাবে তিনি চলতি দায়িত্বে পদ আটকে রেখেছেন বলে অভিযোগ আছে।
দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিধিভঙ্গের অভিযোগ ওঠা এই কর্মকর্তা বিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মাহফুজা আক্তার। এসব অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন তিনি।
বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্র ও ঢাকা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকালে মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ওঠে। চলতি দায়িত্বে চট্টগ্রাম কেন্দ্রের মহাব্যবস্থাপক থাকাকালে ২০২২ সালে একাই পাঁচ শতাধিক অনুষ্ঠান প্রযোজনা করা, অনেক অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচার না করে ৭৯ লাখ টাকার বেশি বিল প্রদান, এক কোডের টাকা আরেক কোডে ব্যবহার দেখিয়ে ১ কোটি ২৯ লাখ ৭৫০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
২০২৩ সালে ঢাকা কেন্দ্রে যোগদানের পর ১৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে।
দরপত্র আহ্বান না করে সরাসরি কেনাকাটায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ২০২১-২২ অর্থবছরেও তাঁর বিরুদ্ধে নিয়ম না মেনে দৈনিক ২৫ হাজার টাকার কেনাকাটায় মোট ৪৭ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয় জানিয়ে মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কয়েকজন শিল্পী অভিযোগ করেন। চট্টগ্রামের শব্দসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা সুজিত রায় অভিযোগ করেন দুদকে।
এদিকে ২০২৩ সালে ঢাকা কেন্দ্রে যোগদানের পর ১৩ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে। মাহফুজা আক্তারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রের দায়িত্ব নেওয়ার পর বরং আমি বিটিভির খরচ কমিয়েছি। এই প্রমাণ কাগজে-কলমে আছে। অভিযোগে উল্লেখ করা ঢাকা কেন্দ্রের এই ১৩ কোটি টাকার অর্থের হিসাব ২০২২ সালের ডিসেম্বরের, যখন আমি চট্টগ্রামে ছিলাম।’
মাহফুজা আক্তার দাবি করেন, চট্টগ্রাম থেকে অভিযোগকারী শিল্পী সুজিত রায় তাঁকে (মাহফুজা) ও মহাপরিচালককে জানিয়েছেন, তাঁর নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ অভিযোগ করেছেন, তিনি নিজে করেননি।
তবে মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে ২১ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদকের উপসহকারী পরিচালক নাঈমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মাহফুজা আক্তার চট্টগ্রাম ও ঢাকায় দায়িত্ব পালনের সময় যত কাজ করেছেন, এর সবকিছু নিয়েই তদন্ত হচ্ছে। বিটিভির পক্ষ থেকে প্রথম দফায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব কাগজ পাঠানো হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় আরও কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রের দায়িত্ব নেওয়ার পর বরং আমি বিটিভির খরচ কমিয়েছি। এই প্রমাণ কাগজে-কলমে আছে। অভিযোগে উল্লেখ করা ঢাকা কেন্দ্রের এই ১৩ কোটি টাকার অর্থের হিসাব ২০২২ সালের ডিসেম্বরের, যখন আমি চট্টগ্রামে ছিলাম।’মাহফুজা আক্তার
মাহফুজা আক্তার ২০০৭ সালে পিএসসির মাধ্যমে প্রযোজক হিসেবে বিটিভিতে যোগদান করেন। ২০২২ সালে তিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা কেন্দ্রের মহাব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে যোগদান করেন। তাঁকে চলতি দায়িত্বে জিএম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ছয় মাসের জন্য। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এই মেয়াদ বাড়ানোর নিয়ম আছে। মেয়াদ বাড়ানো হলে তা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানানোর কথা। তবে বিটিভির প্রশাসন জানিয়েছে, তারা মেয়াদ বাড়ানোর কোনো প্রজ্ঞাপন পায়নি।
বিটিভির কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে মাহফুজা আক্তারের চেয়ে অনেক যোগ্য ও বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আছেন। তাঁদের দায়িত্ব না দিয়ে মাহফুজা আক্তারকে জিএম পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিটিভির প্রতিবেদন বলছে, মাহফুজা আক্তার ঢাকা কেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণের পর তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস) অনুমোদনের অতিরিক্ত নাটক, অনুষ্ঠান করে অতিরিক্ত খরচ করেছেন।
জানতে চাইলে বিটিভির মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ৬ মে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রের ১৩ কোটির কিছু বেশি টাকার যে অনিয়মের অভিযোগ, এটা বকেয়া বিল ছিল। বিটিভিতে আরও কয়েকজনের দায়িত্বের মেয়াদ বাড়ানোর প্রসঙ্গটি আলোচনাধীন। সে অনুযায়ী মাহফুজা আক্তার এই পদের জন্য উপযুক্ত নন অথবা নিয়ম লঙ্ঘন করে অন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের অতিক্রম করে তাঁকে জিএমের চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অভিযোগটি ঠিক নয়। বিটিভির নিয়োগ হয় ৯২ সালের নিয়োগবিধি অনুযায়ী। সে নিয়মে তিনিই দায়িত্ব পান।’
বিটিভির পক্ষ থেকেই মাহফুজা আক্তারের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত করা হয়। তদন্ত কমিটি গত বছরের ২৩ আগস্ট প্রতিবেদন দেয়। সে প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহফুজা আক্তার ঢাকা কেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণের পর তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস) অনুমোদনের অতিরিক্ত নাটক, অনুষ্ঠান করে অতিরিক্ত খরচ করেছেন। তদন্ত কমিটিকে তথ্য ও প্রমাণ সরবরাহ না করে কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন, বিশেষ অনুষ্ঠানের আদেশের কপি সব কার্যালয়ে তিনি পাঠাননি, অনুষ্ঠান ধারণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যয় প্রস্তাবনা অনুমোদন না করে দীর্ঘদিন পরে অর্থ ও হিসাব শাখায় পাঠিয়ে বকেয়া সৃষ্টি করেছেন।