পুলিশের ওপর হামলার সময় যে পিপার স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটিও জঙ্গিদের তৈরি করা।
পুলিশের ওপর হামলা করা জঙ্গিরা হাতকড়া খোলার জন্য নিজেরাই চাবি তৈরি করেছিলেন। কারাগার থেকে আদালতে আনা–নেওয়ার সময় যে হাতকড়া পরানো হয়, সেটি দীর্ঘদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেন তাঁরা। এরপর হাতকড়া খোলার জন্য চার ধরনের চাবি বানান কারাগারের বাইরে থাকা জঙ্গিরা। আর হামলার সময় যে পিপার স্প্রে (মরিচের গুঁড়াসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকের মিশ্রণ) ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটিও জঙ্গিদের তৈরি করা।
আদালতের ফটকের সামনে থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় করা মামলার তদন্তে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তাঁরা বলছেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হলো, সে বিষয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ পাওয়া গেছে। তবে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি ও তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি নেই।
জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। সিটিটিসি সূত্র বলছে, জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয় ছয় মাস আগে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম এই পরিকল্পনা করেছিল। চারজনকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও দুজনকে ছিনিয়ে নিতে পেরেছে তারা। হামলার সময় ছয়টি মোটরসাইকেল ব্যবহারের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে গত মে মাস থেকে তারা মোটরসাইকেল কেনা শুরু করে। জঙ্গি ছিনতাইয়ে অংশ নিয়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। তাঁরা চারটি দলে ভাগ হয়ে কাজ করেছেন। এক দলের সদস্যরা অন্য দলের সদস্যদের চিনতেন না। প্রত্যেকের দায়িত্ব ভাগ করা ছিল। ‘কাট আউট’ (একই কাজে যুক্ত এক দলের তথ্য অন্য দল জানে না) পদ্ধতিতে ওই হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন জঙ্গিরা।
সিটিটিসির উপকমিশনার এস এম নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা জঙ্গি ছিনতাইয়ে জড়িত রয়েছে, তাদের সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।’
গত রোববার (২০ নভেম্বর) চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ফটকে পুলিশকে মারধর ও চোখে পিপার স্প্রে করে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের দুই সদস্যকে ছিনিয়ে নিয়ে যান জঙ্গিরা। তাঁরা হলেন মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত সামির ও মো. আবু ছিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব। ওই দুজনসহ ১২ আসামিকে সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের (সিএমএম) হাজতখানায় নেওয়া হচ্ছিল। ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি হত্যা মামলারও আসামি তাঁরা। দীপন ও অভিজিৎসহ লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যা মামলাগুলোর প্রধান আসামি ও আনসার আল ইসলামের নেতা বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হকের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় জঙ্গি নেওয়ার ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানায় সিটিটিসি।
সিটিটিসি বলছে, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে জঙ্গিদের আদালতে আনা-নেওয়ার পুরো রুট (পথ) সম্পর্কে হামলাকারীরা জানত। সেদিন আদালতে আনা ১২ জঙ্গির মধ্যে ৪ জঙ্গি কীভাবে আলাদা হবেন, সেই নির্দেশনাও তাঁদের আগে থেকেই দেওয়া হয়েছিল। যে দুজনকে ছিনিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি, তাঁরা হলেন আরাফাত রহমান ও আবদুস সবুর রাজু ওরফে সাদ ওরফে সুজন।
আরাফাত রহমান ও আবদুস সবুর সিটিটিসির জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, কারাগারে থেকেও তাঁদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল বাইরে থাকে আনসার আল ইসলামের আসকারি (সামরিক) শাখার জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে। এটি সমন্বয় করছিলেন আসকারি শাখার গুরুত্বপূর্ণ নেতা আয়মান ওরফে মশিউর রহমান। জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
সিটিটিসি সূত্র বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে আরাফাত ও সবুর স্বীকার করেছেন, কারাগারের ভেতরেই তাঁরা মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারতেন। তাঁদের দেওয়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ ও তথ্য বিভাগ (প্রসিকিউশন) বলছে, কারাবিধি অনুযায়ী সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চাঞ্চল্যকর মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি বা একাধিক মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে উপস্থাপনের সময় ডান্ডাবেড়ি পরানোর নির্দেশনা থাকলেও ২০ নভেম্বরের ঘটনায় সেটি মানেনি কারা কর্তৃপক্ষ। ডান্ডাবেড়ি না পরানোর কারণে আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে গত সোমবার কারা মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি দিয়েছে প্রসিকিউশন বিভাগ।
ডিএমপির প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার জসিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়নি বলেই দুর্ঘটনা (জঙ্গি ছিনতাই) ঘটেছে বলে আমরা মনে করি। এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানোর জন্য কারা মহাপরিদর্শক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
আদালত ফটকের সামনে থেকে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় গতকাল চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ আবু সাঈদ মোল্লা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তদন্ত কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কারা অনুবিভাগ)। এ ছাড়া জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও পুলিশ সদর দপ্তর পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এদিকে গতকাল কারা উপমহাপরিদর্শক পদমর্যাদার তিন কর্মকর্তাকে বদলি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাঁদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক এ কে এম ফজলুল হককে ঢাকা বিভাগে বদলি করা হয়েছে। ঢাকা বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামকে রংপুর বিভাগে এবং রংপুর বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক আলতাব হোসেনকে চট্টগ্রাম বিভাগে বদলি করা হয়েছে।
ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গিরা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য গত রোববারই দেশজুড়ে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করা হয়। সীমান্ত এলাকাগুলোতেও নজরদারি বাড়ানো হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গি ছিনিয়ে নিতে আনসার আল ইসলামের আসকারি বিভাগের যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ভারত ফেরত এক জঙ্গিও ছিলেন। তাঁর নাম তানভীর ওরফে শামসেদ মিয়া ওরফে সাইফুল ওরফে তুষার। তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জের ছাতকে। ২০১৬ সালে দেশব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় তিনি ভারতে পালিয়ে যান। ওই সময় অনেক জঙ্গি ভারতের আসাম ও ত্রিপুরায় আশ্রয় নেন। সেখানে কয়েক বছরে আনসার আল ইসলামের ২০ জনের অধিক সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন।
হামলায় অংশ নেওয়া তানভীর ওরফে শামসেদ মিয়া সীমান্ত দিয়ে পালানোর পথ চেনেন। এ কারণে কুমিল্লার সীমান্ত দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গি ভারতে পালানোর চেষ্টা করতে পারেন। তবে সিটিটিসির ধারণা, জঙ্গিরা এখনো সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেননি। তাঁরা ঢাকা এবং আশপাশের কোথাও আশ্রয় নিয়েছেন।