জাহাঙ্গীর আলম, মো. আবু জাফর, সৈয়দ আবেদ আলী ও সৈয়দ সোহানুর রহমান
জাহাঙ্গীর আলম, মো. আবু জাফর, সৈয়দ আবেদ আলী ও সৈয়দ সোহানুর রহমান

সিআইডির অভিযান

প্রশ্নপত্র ফাঁসে পিএসসির তিন কর্মকর্তাসহ গ্রেপ্তার ১৭

বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়ামও রয়েছেন।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল ইসলাম সোমবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই ১৭ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন। তাঁরা একাধিক নন-ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসেও জড়িত বলে জানা গেছে। তাঁদের সিআইডি কার্যালয়ে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর গত রোববার পিএসসির অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে পিএসসির কর্মকর্তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়।

সিআইডি জানিয়েছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, কর্মচারী (ডেসপাস রাইডার) মো. খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম এবং সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান।

সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশিদ, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তাপ্রহরী মো. শাহাদত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টেকনিশিয়ান নিয়ামুন হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর মো. সাখাওয়াত হোসেন ও সাইম হোসেন, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম এবং যুবক লিটন সরকারও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডি কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, পিএসসির কোনো নিয়োগ পরীক্ষা এলেই এই চক্রের সদস্যরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থ নিতেন। ৫ জুলাই (শুক্রবার) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন তাঁরা। চক্রের সদস্যরা ওই পরীক্ষার আগের রাতে তাঁদের চুক্তি করা শিক্ষার্থীদের অজ্ঞাতনামা স্থানে রেখে ওই প্রশ্নপত্র ও তাঁর উত্তর দিয়ে দেন।

পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নটি উপপরিচালক মো. আবু জাফরের কাছ থেকে তিনি নিয়েছিলেন। এর জন্য আবু জাফরকে তিনি ২ কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এর আগেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষের ট্রাঙ্ক খুলে তিনি প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে সেগুলো ফাঁস করেছেন। সেগুলোর মধ্যে বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও রয়েছে। এ কাজে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী বিভিন্ন সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করা হবে।

নির্বাচন করতে চান আবেদ আলী

এদিকে সৈয়দ আবেদ আলী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি ও তাঁর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান দামি গাড়ি চালাচ্ছেন, হোটেল উদ্বোধনের কথা বলছেন।

সৈয়দ আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত আবদুর রহমান মীরের ছেলে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবদুর রহমান মীরের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে আবেদ আলী মেজ। তাঁর এক ভাই কৃষিকাজ করেন। আরেক ভাই অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে এলাকার মানুষের কাছে আবেদ আলী পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে।

স্থানীয় সূত্র বলছে, আবেদ আলী নিজ গ্রামে প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ করে বিলাসবহুল ‘ডুপ্লেক্স’ বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাড়ির পাশে করেছেন মসজিদ। তিনি মাদারীপুরে গরুর খামার ও বিপণিবিতান নির্মাণ করছেন, যার একাংশ সরকারি জমিতে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আবেদ আলীর গ্রামের সূত্র জানিয়েছে, তিনি মাত্র আট বছর বয়সে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় যান। সেখানে কুলির কাজ করতেন। এরপর গাড়ি চালানো শিখে চাকরি নেন পিএসসিতে।

দুই বছর আগে থেকে আবেদ আলী তাঁর নিজ এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। তিনি চেয়েছিলেন নতুন উপজেলা ডাসারের উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে। এই নির্বাচনের তফসিল এখনো হয়নি। তবে তিনি প্রার্থী হতে দীর্ঘদিন থেকে প্রচার চালাচ্ছেন। এলাকায় তিনি দামি গাড়িতে চড়ে গণসংযোগ করেন।

সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। সোমবার তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এদিকে কুয়াকাটার সান মেরিনা হোটেল নিজের বলে দাবি করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন আবেদ আলী। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের নতুন হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম আজ। সমুদ্রকন্যার পাড়ে আজীবন নিজের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা ও একই সঙ্গে একটা হোটেলের মালিকানা অর্জন করতে আপনিও শেয়ার কিনতে পারেন। শেয়ার কিনতে যোগাযোগ করুন।’

কুয়াকাটায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সান মেরিনা হোটেলটি এখনো নির্মিত হয়নি। সেখানে জমি খালি। শুধু শ্রমিকদের জন্য ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। জমিটি নিজের বলে দাবি করেন লিবার্টি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই-তিন মাস আগে আবেদ আলী তাঁর হোটেলের সামনে অন্য একটি হোটেলে ওঠেন। পরদিন সকালে তাঁর হোটেলের জায়গায় গিয়ে শেয়ার কেনার কথা বলেন।

মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আবেদ আলী আমার লোকদের কাছ থেকে শেয়ার কেনার বিস্তারিত জেনে যান। এ পর্যন্তই। আসলে আমি কখনো তাঁকে দেখিনি এবং চিনি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আবেদ আলীকে একজন টাউট প্রকৃতির লোক বলে মনে হয়েছে। আমি এ জন্য ঢাকার গুলশান থানায় জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করব।’