জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দ্রুত তৈরি করে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিত চক্রটি। টাকার বিনিময়ে তারা অবৈধভাবে পরিচয়পত্রের নানা তথ্য পরিবর্তন করত। ভুয়া পরিচয়পত্র দিয়ে তারা রোহিঙ্গাদের তৈরি করে দিত পাসপোর্ট। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল।
গত মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিআইডি। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মো. শামসুল করিম (৪১), টিপু সুলতান (৪১) ও মো. রিয়াজ খান (২৬)।
পুলিশ জানায়, চক্রটির প্রতারণায় ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় গ্রেপ্তার তিনজনসহ মোট ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন ও সিআইডির সূত্রের দেওয়া তথ্যে এই প্রতারক চক্রের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের চিত্র উঠে এসেছে।
জানা গেছে, আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ভবনে সেবা নিতে আসা ব্যক্তিদের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করত চক্রটি। পরে তারা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের পরিচয় দিয়ে সেসব নম্বরে ফোন দিত। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি এভাবে এক সেবা গ্রহীতার কাছে ফোন করা হয়। নির্বাচন কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরিচয়ে সেবা গ্রহীতার কাছে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি জন্য টাকা চাওয়া হয়। যদিও সে সময় নির্বাচন কমিশনের এই কর্মকর্তা দেশের বাইরে ছিলেন।
এ বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনে যাঁরা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে বা কোনো কাজে আসতেন, তাঁদের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে প্রতারণা করত চক্রটি। তারা এই নম্বরগুলো কীভাবে সংগ্রহ করত, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নম্বর নির্বাচন কমিশনের কেউ দিত, নাকি অন্য কোনো মাধ্যমে তারা পেত, তা তদন্ত করা হচ্ছে। সিআইডিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন ও সিআইডি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা ও বিভিন্ন অপরাধীকে ভুয়া পাসপোর্ট তৈরিতেও এই চক্রটি জড়িত। এ ক্ষেত্রে তারা তিনটি পর্যায়ে কাজ করত। প্রথমে ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করত। সেটি ব্যবহার করে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হতো। সেই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তৈরি করে দেওয়া হতো ভুয়া পাসপোর্ট। এভাবেই কক্সবাজারের ওমর ফারুক নামের এক রোহিঙ্গার পাসপোর্ট তৈরি করে দেয় চক্রটি। এ কাজে প্রথমে তারা একই নামের চট্টগ্রামের এক কৃষকের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে। পরে তাঁর নাম, ঠিকানা ও পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কক্সবাজারের ওই রোহিঙ্গার পাসপোর্ট তৈরি করে দেওয়া হয়।
সূত্র বলছে, জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম, ঠিকানা, বয়সসহ বিভিন্ন তথ্য অবৈধভাবে পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিত চক্রটি। এসব লেনদেনের জন্য তারা মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএসএফ) ব্যবহার করত। তথ্য পরিবর্তনের কাজে নির্বাচন কমিশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী চক্রটিকে সহায়তা করতেন। বিনিময়ে অর্থ নিতেন তাঁরা। জাতীয় পরিচয়পত্রের বায়োমেট্রিক তথ্য দ্রুত নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোডের আশা দিয়েও টাকা নিত চক্রটি। এ ছাড়া ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে ব্যাংকঋণ পেতে সহায়তা করত তারা।
এ বিষয়ে সিআইডির প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) মোহাম্মদ আলী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রতারকেরা সাধারণ আবেদনকারীর প্রকৃত বয়স কমিয়ে, নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দিয়েছে। এতে নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সহযোগিতা করেছেন। পুরো চক্রটি খুঁজে বের করা হবে।