চাঁদাবাজি
চাঁদাবাজি

চাঁদা ওঠে ‘৮০ কোটি টাকা’, ‘নিয়ন্ত্রকেরাই’ রাজনীতিতে প্রভাবশালী

  • উত্তরাঞ্চলের ১১টি জেলা থেকে ঢাকা ও অন্য অঞ্চলে পরিবহনের কেন্দ্র বগুড়া।

  • বাস, ট্রাক, তিন চাকার যানবাহন থেকে চাঁদা বছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকা।

লাখের নয়, হিসাব কোটির। তা–ও এক কোটি বা দুই কোটি নয়, বছরে চাঁদা ওঠে ‘প্রায় ৮০ কোটি’ টাকা। পরিবহনের এই চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে বগুড়া আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা–কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত।

বগুড়ায় পরিবহনে চাঁদাবাজি যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরাই আবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের জন্যই তাঁরা আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা–কর্মীদের নিয়ে নিজস্ব দল গড়েন। দুই পক্ষের মধ্যে মহড়া দেওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটেছে।

বগুড়া আওয়ামী লীগে জেলার পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণকেরাই প্রভাবশালী। কোন্দল চাঁদাবাজি ঘিরে।

দেশের উত্তরাঞ্চলের ১১টি জেলা থেকে ঢাকা ও অন্য অঞ্চলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের কেন্দ্র বগুড়া। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরিবহনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নামে যানবাহন থেকে চাঁদা ওঠানো হয়। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন দলটির নেতারা পরিবহন খাত থেকে চাঁদা তুলতেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে দলের নেতাদের হাতে।

পুলিশ ও পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বগুড়ার ওপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এর মধ্যে বাস তিন হাজার ও ট্রাক সাড়ে তিন হাজার। প্রতিটি বাস–ট্রাক থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা ওঠানো হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এই হিসাবে বছরে বড় যানবাহন থেকে চাঁদা ওঠে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। এর বাইরে এই জেলায় প্রায় ১০ হাজার তিন চাকার যান্ত্রিক যান চলে। এসব যানবাহন প্রতিটি থেকে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এই হিসাবে তিন চাকার যান্ত্রিক যান থেকে চাঁদা ওঠে প্রায় ২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বগুড়ায় শুধু পরিবহনকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন সংগঠনের নামে বছরে চাঁদা ওঠে প্রায় ৮০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, শাহ আক্তারুজ্জামানের পক্ষটি তিন বছর ধরে পরিবহনে চাঁদাবাজির মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়েছে।

এক যুগের বেশি সময় ধরে ঘুরেফিরে বগুড়ার পরিবহনের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেছেন ছয় নেতা। স্থানীয় লোকজন বলছেন, তাঁরা এখন দুটি পক্ষে বিভক্ত। এক পক্ষে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং বগুড়া জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আক্তারুজ্জামান (ডিউক)। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও বগুড়া জেলা বাস মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, আন্তজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মান্নান, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকার এবং পরিবহন নেতা শামসুদ্দীন শেখ হেলাল।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, শাহ আক্তারুজ্জামানের পক্ষটি তিন বছর ধরে পরিবহনে চাঁদাবাজির মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়েছে। অন্য পক্ষটির নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম (মোহন)। তাঁর প্রভাব কমেছে। যদিও এই শাহ আক্তারুজ্জামানের পক্ষে থাকা আমিনুল, মান্নান, মতিন ও শামসুদ্দিনের উত্থান হয়েছিল মঞ্জুরুলের হাত ধরে।

পরিবহনে যে চাঁদাবাজি হয়, সেটির নিয়ন্ত্রণ শ্রমিকদের হাতে নেই। যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা এখন শ্রমিকনেতা থেকে বড় ব্যবসায়ী বনে গেছেন। তাঁরা এখন কোটিপতি। তিনি বলেন, চাঁদাবাজির টাকা শ্রমিকদের কল্যাণেও ব্যয় হয় না। পুরো টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করেন নিয়ন্ত্রকেরা।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ফরিদ

চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুবলীগ নেতা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলেন মঞ্জুরুল আলম। তখন পাল্টাপাল্টি হামলা এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছিল।

আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মঞ্জুরুল আলমের সঙ্গে এখন আর ঝামেলা নেই। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুই পক্ষই এক হয়ে গেছে। তিনি বলেন, পরিবহনে আগে চাঁদাবাজি হতো। এখন আর হয় না। এখন যেটা হয়, তা সমিতির কেন্দ্র থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। মালিক সংগঠনের নামে ৩০ টাকা এবং শ্রমিক সংগঠনের নামে ৩০ টাকা চাঁদা ওঠানো হয়।

মঞ্জুরুল আলমের ভাষ্যও একই। তিনি বলেন, ২০২১ সালে হওয়া মামলাগুলো আপস হয়ে গেছে। এখন আর কোনো বিরোধ নেই। তবে তিনি এখন আর পরিবহনসংক্রান্ত বিষয়ে সক্রিয় নন। এখন চাঁদা তোলা হয় কি না, সেটিও তিনি বলতে পারবেন না।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা গেছে, আগেও সমিতির নামেই চাঁদা ওঠানো হতো। এখনো একইভাবে হয়। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে ওঠানো চাঁদার কোনো সঠিক হিসাব রাখা হয় না। শ্রমিকদের কল্যাণের বদলে তা অনেকাংশে ভাগ–বাঁটোয়ারা হয়। বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পান না।

চাঁদা নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনেকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তবে নাম প্রকাশ করে কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি। পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) বগুড়া জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহনে যে চাঁদাবাজি হয়, সেটির নিয়ন্ত্রণ শ্রমিকদের হাতে নেই। যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা এখন শ্রমিকনেতা থেকে বড় ব্যবসায়ী বনে গেছেন। তাঁরা এখন কোটিপতি। তিনি বলেন, চাঁদাবাজির টাকা শ্রমিকদের কল্যাণেও ব্যয় হয় না। পুরো টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করেন নিয়ন্ত্রকেরা।

মতিনকে তখন যুবলীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়নি তাঁর। পরে তিনি বগুড়া পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছেন।

রাজনীতিতে আধিপত্য তাঁদের

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ২০০৯ সাল পর্যন্ত বগুড়ায় আওয়ামী লীগে একক কর্তৃত্ব ছিল দলের তখনকার জেলা সভাপতি মমতাজউদ্দীনের হাতে। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট নেতাদের আধিপত্য শুরু হয়। তখন জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন মঞ্জুরুল আলম। তিনি কয়েকজনকে নিয়ে পরিবহন খাতে চাঁদার নিয়ন্ত্রণ নেন। ২০১৪ সালে মঞ্জুরুল জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পান। এরপর দলে তাঁর ব্যাপক প্রভাব তৈরি হয়। মঞ্জুরুল দলের অভ্যন্তরে মমতাজউদ্দীন বিরোধী একটি শক্তিশালী পক্ষ তৈরি করেন।

বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মঞ্জুরুল আলম জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার পর তাঁর হাত ধরেই দলে পরিবহন নেতাদের আধিপত্য শুরু হয়।

জেলা আওয়ামী লীগের পদধারী একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে দলের জেলা সভাপতি ও বগুড়া-৫ আসনের (শেরপুর-ধুনট) সংসদ সদস্য মজিবর রহমানের পক্ষটি। কারণ, পরিবহনে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণকারী তাঁরা। যদিও মজিবর প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত কোনো পরিবহন নেতাকে তিনি প্রশ্রয় দেন না।

আগে দেখতাম রাজনীতিবিদেরা জনগণের মধ্যে থাকেন, সঙ্গে থাকেন। সংস্কৃতি অঙ্গনেও তাঁদের পদচারণ ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে বিত্তশালী, পেশিশক্তিধারী, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক, ভূমিদস্যু, দখলবাজদের দাপট বেশি। ভালো মানুষেরা এখনো আছেন, তবে তাঁরা কোণঠাসা।
সনাক বগুড়ার সাবেক সভাপতি বজলুল করিম বাহার

চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক থেকে দলে পদ

 ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের এখনকার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম। ওই সময়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী আমিনুলকে বগুড়া সদর উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং মতিন সরকারকে বগুড়া শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়, যাঁরা পরিবহনে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

যুবলীগের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালে এক ছাত্রীকে মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার ঘটনায় মতিন ও তাঁর ভাই তুফান সরকারের নানা অপকর্মের বিষয়টি সামনে আসে। মতিনকে তখন যুবলীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়নি তাঁর। পরে তিনি বগুড়া পৌরসভার কাউন্সিলর হয়েছেন।

ওই নেতার ভাষ্য, ২০১৯ সালে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপি নেতা মাহবুব আলম হত্যার ঘটনা ঘটে। এতে আমিনুলের সংশ্লিষ্টতা উঠে আসার পর তাঁকে যুবলীগের পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু পরে বগুড়ার রাজনীতিতে তাঁর প্রভাবের কারণে বহিষ্কারাদেশ তুলে নিতে হয়। তিনিও একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।

আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণেই তাঁকে মাহবুব খুনের মামলায় আসামি করা হয়েছে।

অবশ্য মামলাটির তদন্ত শেষে পুলিশ আমিনুল ইসলামকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে।

‘তাঁরা কোণঠাসা’

বগুড়া আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব, দলাদলি খুনোখুনির বহু ঘটনা ঘটেছে। জেলা পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও জেলার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ এবং দলের সহযোগী ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হয়েছেন ৫১ জন।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বগুড়ার সাবেক সভাপতি বজলুল করিম বাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে দেখতাম রাজনীতিবিদেরা জনগণের মধ্যে থাকেন, সঙ্গে থাকেন। সংস্কৃতি অঙ্গনেও তাঁদের পদচারণ ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে বিত্তশালী, পেশিশক্তিধারী, চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক, ভূমিদস্যু, দখলবাজদের দাপট বেশি। ভালো মানুষেরা এখনো আছেন, তবে তাঁরা কোণঠাসা।’