নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আলোচিত যুব মহিলা লীগের সাবেক নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া কারাগারের ভেতরেও অপরাধী চক্র গড়ে তুলেছিলেন। ২০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত পাপিয়া ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণসহ সহযোগী কয়েদিদের সঙ্গে নিয়ে সাধারণ নারী বন্দীদের নির্যাতন করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত জুনে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাপিয়ার নেতৃত্বে তৎকালীন বন্দী শিক্ষানবিশ আইনজীবী রুনা লায়লাকে নির্যাতন করা হয়।
এ ঘটনা তদন্ত করে কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ওবায়দুর রহমান কারা মহাপরিদর্শককে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন, তাতে পাপিয়ার সংশ্লিষ্টতা উঠে এসেছে। ৫ জুলাই পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শামীমা নূর পাপিয়াসহ অন্য বন্দীরা হাজতি বন্দী রুনা লায়লাকে মারধর ও আঘাত করেছেন। এ ছাড়া রুনার ভাই আবদুল করিম বোনের সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে গেলে তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। অন্য বন্দীকে রুনা সাজিয়ে তাঁর সঙ্গে ভুয়া টেলিফোন আলাপ করানো হয়।
ঢাকার কোতোয়ালি থানার একটি মামলায় শিক্ষানবিশ আইনজীবী রুনা লায়লাকে ১৬ জুন কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়। কারাগারে নেওয়ার পর রুনার দেহ তল্লাশি করে কর্তব্যরত মেট্রন তাঁর কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা পান। ওই টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য পাপিয়া ও তাঁর সহযোগীরা ১৯ জুন রুনাকে নির্যাতন করেন।
অভিযোগ রয়েছে, একপর্যায়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রুনাকে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। এ নিয়ে কারাগারের ভেতরে সালিস বসে (কেস টেবিল)। সেখানে ত্রিমুখী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন বন্দী ও কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঘটনার পর চলতি মাসের শুরুতে পাপিয়াকে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
২৭ জুন জামিনে মুক্তি পাওয়া রুনা লায়লা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা ছিল। সেই টাকা কেড়ে নেওয়ার জন্য শামীমা নূর পাপিয়াসহ তাঁর সহযোগীরা আমাকে সিসি ক্যামেরা নেই এমন স্থানে নিয়ে যান। টাকা দিতে অস্বীকার করলে তাঁরা জোর করে সেই টাকা নিয়ে যান। পরে পাপিয়া ও তাঁর সহযোগীরা শিকল দিয়ে আমার হাত-পা বেঁধে অমানবিকভাবে মারধর করে। আমাকে না মারার জন্য পাপিয়ার হাত–পায়ে ধরেছি। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি।’
জেল সুপারের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, রুনা লায়লাকে কারাগারে আনার পর কারাবিধি অনুযায়ী তাঁর নাম–ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপর প্রধান ফটকে দায়িত্বরত মহিলা কারারক্ষীরা তল্লাশি করার পর তাঁকে কারাগারের ভেতরে ঢোকানো হয়। সে সময় তাঁর কাছে কোনো টাকা পাওয়া যায়নি। ১৮ জুন দুপুরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মেট্রন ফাতেমা দুজন বন্দীকে সঙ্গে নিয়ে ৪০১ নম্বর ওয়ার্ডে তল্লাশি করেন এবং রুনার কাছ থেকে নগদ ৭ হাজার ৪০০ টাকা উদ্ধার করেন। তদন্তে দেখা গেছে, গত ১৯ জুন সকালে উদ্ধার করা টাকার বিষয়ে বিচার বৈঠকে হাজির করা হলে বন্দী রুনা লায়লা মেট্রন ফাতেমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে শুরু করেন এবং কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে মেট্রন ফাতেমার গায়ে আঘাত করেন। পরে পাপিয়াসহ অন্য বন্দীরা রুনা লায়লাকে মারধর করেন।
জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ওবায়দুর রহমান বলেন, রুনা লায়লাকে নির্যাতন করায় মেট্রন ফাতেমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মহাপরির্শকের কাছে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া তিনজন নারী কারারক্ষী যাঁরা রুনা লায়লাকে নির্যাতন করেছেন এবং তল্লাশির দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের কাছে লিখিত কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, কারা বিভাগের ডিআইজি, জেল সুপার, জেলার সক্রিয় থাকলে কাশিমপুরে মহিলা কারাগারের এমন ঘটনা ঘটার কথা না। বন্দীরা কেন আরেকজন বন্দীকে নির্যাতনের সাহস পাবে?
কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারের রেকর্ড বইয়ে পাপিয়ার বিভিন্ন অপকর্মের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়, পাপিয়া হাজতি রুনা লায়লা ছাড়াও বেশ কয়েকজন বন্দীকে গালাগালি ও ভয়ভীতি দেখাতে আঘাত করেছেন। এ ছাড়া তিনি কারাগারের রজনীগন্ধা ভবনে অন্য বন্দী দিতে চাইলে আপত্তি জানিয়েছিলেন।
পাপিয়া গাজীপুরের তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেলে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কারারক্ষীদের ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ইচ্ছেমতো অন্য বন্দীদের সেল পরিবর্তন করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর কক্ষ তল্লাশি করে স্মার্টফোন ও চার্জার পাওয়া যায়।
ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেলে বিলাসবহুল কক্ষ ভাড়া নিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতেন পাপিয়া। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের বিষয়ে আঁচ পেয়ে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দর থেকে পাপিয়া ও তাঁর স্বামী মফিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর পাপিয়াকে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওই বছরই অস্ত্র মামলায় পাপিয়া ও তাঁর স্বামীর ২০ বছরের কারাদণ্ড হয়। এখনো তাঁদের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলার বিচার চলছে।