অনলাইন জুয়া

গেমের নামে জুয়া, ১৭৪ কোটি টাকা লোপাট

গেম বানানোর কথা বলে বিনিয়োগের অনুমোদন নিয়ে অনলাইন জুয়া চালু করেছে ভারতীয় মুন ফ্রগ ল্যাবস কোম্পানি।

  • তিন পাত্তি গোল্ড, কেকে পাত্তি, তাস পাত্তি ও তিন পাত্তি এইচ প্রো নামের জুয়া চালু করা হয়েছে।

  • এসব জুয়া খেলে জিততে পারেন না কেউই।

  • জুয়া খেলার জন্য একধরনের ‘ভার্চ্যুয়াল চিপ’ কিনতে হয়।

অনলাইন গেম বানানোর কথা বলে বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনুমতি নেয় ভারতের মুন ফ্রগ ল্যাবস কোম্পানি। পরে প্রতিনিধি (এজেন্ট) নিয়োগ দিয়ে কৌশলে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’সহ চারটি জুয়ার ওয়েবসাইট পরিচালনায় নামে তারা। এভাবে অনলাইনে জুয়ার মাধ্যমে গত ৩ বছরে ১৭৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কোম্পানিটি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) অনুসন্ধানে অপরাধের এ তথ্য উঠে এসেছে।

রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার অনলাইনে জুয়া চালানোর অভিযোগে বেনজির হোসেন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। ওই দিনই পুলিশ বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বেনজিরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার বাকি আসামিরা পলাতক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনলাইনে খেলা যায়, এমন গেম বানানোর কথা বলে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছ থেকে বিনিয়োগের অনুমতি নেয় মুন ফ্রগ ল্যাবস কোম্পানি। পরে উল্কা গেমস লিমিটেড নামে কোম্পানি খুলে অনলাইন জুয়া ‘তিন পাত্তি গোল্ড’, ‘কেকে পাত্তি’, ‘তাস পাত্তি’ ও ‘তিন পাত্তি এইচ প্রো’ চালু করে। টাকা দিয়ে এসব জুয়া খেলে কেউই জিততে পারেন না বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাইবার টহলের (প্যাট্রোলিং) মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়টি আমরা জানতে পারি। পরে অভিযান চালিয়ে বিদেশি কোম্পানির একজন প্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ অনলাইনে জুয়া পরিচালনার সঙ্গে জড়িত প্রতিনিধি ও উপপ্রতিনিধিদের নাম পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশে উল্কা গেমস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জামিলুর রশীদ। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে অনলাইন গেম নিয়ে ভারতে একটি এক্সপোতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে মুন ফ্রগ ল্যাবস কোম্পানির লোকজনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে তাঁর মাধ্যমেই বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া চালু করে কোম্পানিটি।

মামলার এজাহার সূত্রে ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেম খেলে অনলাইনে টাকা উপার্জনের কথা বলে কোম্পানির প্রতিনিধিরা মানুষকে জুয়া খেলতে উৎসাহিত করেন। জুয়া খেলার জন্য একধরনের ‘ভার্চ্যুয়াল চিপ’ কিনতে হয়। কোম্পানির কাছ থেকে প্রতিনিধিরা ১ কোটি ভার্চ্যুয়াল চিপ কেনেন ১০ হাজার টাকায়। প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সেগুলো ১১ থেকে ১২ হাজার টাকায় কেনেন উপপ্রতিনিধিরা। জুয়ার সাইটে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে ওই উপপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে আরও বেশি দামে ওই চিপ কিনতে হয়।

জানতে চাইলে উল্কা গেমস লিমিটেডের সিইও জামিলুর রশীদ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা লুডু, তিন পাত্তিসহ বেশ কিছু গেম তৈরি করেছি। মানুষ চাইলে এগুলো বিনা টাকায় খেলতে পারেন, আবার টাকার বিনিময়েও খেলতে পারেন।’ গত তিন বছরে (২০১৯-২০ থেকে ২০২১–২২ অর্থবছর) তাঁরা ১৭৪ কোটি টাকা আয় করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোম্পানির শর্ত অনুযায়ী আয়ের একটা অংশ মাদার কোম্পানিতে (মুন ফ্রগ ল্যাবস) পাঠানো হয়েছে।

অনলাইন গেমের জন্য পরিচিত মুন ফ্রগ ল্যাবস কোম্পানি ২০১৪ সালে ভারতে ব্যবসা শুরু করে। বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার পুরোটা পরিচালনা করা হয় ভারত থেকে। এসব জুয়ার ওয়েবসাইটে ঢুকতে হয় ভিপিএন (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) দিয়ে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যথাযথ নজরদারি না থাকায় গেম বানানোর কথা বলে অনলাইন জুয়া চালানোর সুযোগ পেয়েছে কোম্পানিটি। বিনিয়োগের নামে দেশে এসে বিদেশি কোম্পানিগুলো কী করছে, তা নজরদারির আওতায় আনতে হবে। না হলে দেশ থেকে যেমন অর্থ বাইরে চলে যাবে, তেমনি দেশের তরুণ সমাজসহ নানা বয়সী মানুষ জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়বেন।

অনলাইন জুয়ায় যুক্ত একটি কোম্পানিকে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়াকে গতকাল রাতে মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি সাড়া দেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠিয়েও জবাব পাওয়া যায়নি।