‘রাত ৪টায় আমাকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় তিনতলার একটা কক্ষে। কক্ষের নম্বর মনে নেই। সেখানে গিয়ে দেখি জাহিদ হোসেন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেন আছে। তাদের এর মধ্যে মারধর করা হয়েছে। এরপর আমাকে স্টাম্প, পাইপ ও লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু হয়।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতনের শিকার চার ছাত্রের একজন আবু রাইয়াত এভাবে নির্যাতনের সেই রাতের বর্ণনা দেন। গত বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে পর্যায়ক্রমে বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তাঁদের নির্যাতন করা হয়। ছাত্রশিবির সন্দেহে তাঁদের মারধর করা হয়। তাঁরা চারজনই এমবিবিএস চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে দুজন জাহিদ হোসেন ও সাকিব হোসেন এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অপর দুজন কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে ফিরে যান। সেখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
চমেকে চিকিৎসাধীন জাহিদ হোসেন ও সাকিব হোসেন ঘটনা নিয়ে কথা বলতেও নারাজ। তাঁদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। গতকাল শুক্রবার রাতে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আবু রাইয়াতের সঙ্গে। তিনি সেই বিভীষিকাময় রাতের নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরেন।
আবু রাইয়াত বলেন, তাঁকে ভোর ৪টার দিকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায় তিনতলার কক্ষটিতে। সেখানে সাকিব ও ওয়াকিল তখন মারধরে কাতর। রাইয়াতের ওপরও শুরু হয় নির্যাতন। এর কিছুক্ষণ পর ফজরের আজানের আগে ওই কক্ষে ডাকা হয় মোবাশ্বির হোসেনকে।
পরে আবু রাইয়াত জানতে পারেন ওই কক্ষটিতে রাত সাড়ে ১২টায় প্রথমে ডাক পড়ে সাকিব হোসেনের। এরপর রাত দেড়টার দিকে ওয়াকিলকে ডাকা হয়। স্টাম্প, লাঠি ও রাবারের পাইপ দিয়ে তাঁদের মারা হয়। শিবিরনিয়ন্ত্রিত রেটিনা কোচিং সেন্টারে ক্লাস কেন নেয় অভিযোগ করে মারধর করা হয়। এ সময় কক্ষটিতে ১৫ জনের মতো ছিলেন। তবে কে কে ছিলেন, তা মুখে আনতে নারাজ রাইয়াত।
আবু রাইয়াত বলেন, ‘যাঁদের নাম পত্রিকায় এসেছে, তাঁরাই আমাদের নির্যাতন করেন। কিন্তু যে অভিযোগে মারধর করা হয়েছে, তা সত্য নয়।’ তাঁদের হাত, পা, মুখমণ্ডল ও পিঠে পেটানো হয়। একসময় ভোরের দিকে রাইয়াত অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন ছাত্রলীগের নেতারা তাঁকে চমেক জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আবার ছাত্রাবাসে নিয়ে যান। তাঁকে নিজ কক্ষে পাঠিয়ে দেন। এরপর বৃহস্পতিবার সারা দিন কক্ষে ছিলেন রাইয়াত। পরে বিকেলের দিকে বাড়িতে চলে যান।
আবু রাইয়াত বলেন, ‘আমাদের মুঠোফোনও তাঁরা নিয়ে নেন। হাসপাতাল থেকে পরে রুমে ছিলাম। কিন্তু ভয় হচ্ছিল, আবার যদি ডাক পড়ে। তাই বাড়িতে চলে আসি। এসে ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ি। পরে বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই।’
ছাত্রলীগের অভিজিৎ দাশের নেতৃত্বে তাঁদের পেটানো হয়। অভিজিৎ দাশ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন। চমেকে ছাত্রলীগের আরেকটি পক্ষ রয়েছে। সেই পক্ষটি সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী।
অভিযোগের বিষয়ে চমেক ছাত্রলীগের মহিবুলপন্থী গ্রুপের নেতা অভিজিৎ দাশ সাংবাদিকদের বলেন, তারা শিবিরের কার্যক্রম চালাচ্ছিল। তাদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। মারধর করা হয়নি।
এ ঘটনার পর চমেক অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। প্রধান ছাত্রাবাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের মজুমদার বলেন, ‘যে ছাত্ররা মারধরের শিকার, তাদের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। আমরা অভিযুক্তদের বের করার চেষ্টা করছি।’
আহত ছাত্ররা এ বিষয়ে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে নারাজ। তাঁদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। চমেক অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে তারা কারও নাম বলছে না এখনো।
২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মারামারির পর চমেক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন মারামারিতে মহিবুলপন্থী মাহাদি জে আকিব নামের এক ছাত্র গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তাঁর মাথার খুলির হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এরপর চমেক ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।