চট্টগ্রামের ছেলে তামজিদ রহমান (৩৫)। তিনি দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করে উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া যান। অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা শেষ করে তিনি সেখানকার একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে ভালো বেতনে পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছয় বছর কাজ করে এই চাকরি ছেড়ে তিন বছর আগে দেশে ফেরেন তামজিদ।
চাকরির টাকা ও বিদেশে থাকা বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া বিনিয়োগ দিয়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নে জমি কিনে তৈরি পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম (গার্মেন্ট এক্সেসরিজ) তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব থাকা তামজিদের অভিযোগ, ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া থেকে শুরু করে কারখানা নির্মাণের জমিতে বালু ভরাটসহ নানা কাজে তাঁকে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এই চাঁদা নেন বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্যাহ ও তাঁর লোকজন।
চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড একটি শিল্পঘন এলাকা। এখানে পুলিশের বিরুদ্ধেও ‘চাঁদাবাজির’ অভিযোগ আছে। ৬ ডিসেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় ‘চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড: ওসির ‘চাঁদাবাজি’ ১৯৬ কারখানায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে অনুসন্ধানে উঠে আসে, সীতাকুণ্ড থানা এলাকার ১৯৬টি কারখানা-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। চাঁদাবাজির এই অভিযোগ পুলিশের সীতাকুণ্ড থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদের বিরুদ্ধে।
৭ ডিসেম্বর ওসি তোফায়েলকে সীতাকুণ্ড থানা থেকে সরিয়ে একই জেলার বাঁশখালী থানায় বদলি করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে একই দিন তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর।
এখন সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেল।
তামজিদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেড লাইসেন্সের জন্য ইউপি চেয়ারম্যান তাঁর কাছে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। পাঁচ হাজার টাকার ট্রেড লাইসেন্স তিনি শেষ পর্যন্ত আড়াই লাখ টাকা দিয়ে নেন। কারখানার জমি কেনার সময়ও তাঁকে চাঁদা দিতে হয়েছে। জমিতে বালু ভরাটের সময় ইউপি চেয়ারম্যানের লোকজন এসে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না পেয়ে গত মাসের শুরুর দিকে তাঁর নির্মাণাধীন কারখানায় হামলা করা হয়। এতে তাঁর নির্মাণাধীন কারখানার তত্ত্বাবধায়ক ও একজন নিরাপত্তাকর্মী আহত হন।
তামজিদ বলেন, হামলার ঘটনায় তিনি সীতাকুণ্ড মডেল থানায় মামলা করেন। এই মামলায় একজন গ্রেপ্তার হন। পরে ওই ব্যক্তি জামিনে বেরিয়ে আসেন। তাঁকে ফুল দিয়ে বরণ করেন ইউপি চেয়ারম্যান। এই মামলায় বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য ইব্রাহীম খলিল ইকরামকেও আসামি করা হয়েছে।
ব্যবসায়ী তামজিদ জানান, এখন তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সে কারণে ভয়ে তিনি নির্মাণাধীন কারখানায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে প্রথম আলোকে বলেন, বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন এলাকায় স্টিল মিলের কারখানা করার জন্য তিনি দুই লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন। তাঁর কাছে ইউপি চেয়ারম্যান ১০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন।
এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, শুধু পুলিশ নয়, এখানে ব্যবসা করতে হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও চাঁদা দিতে হয়।
চলতি মাসে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন এলাকায় গিয়ে সেখানকার আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই তিন ব্যবসায়ীর অভিযোগ, বাড়বকুণ্ডে কারখানা করার জন্য যিনি জমি কিনবেন, তাঁকে চাঁদা দিতে হয়। যিনি জমি বিক্রি করেন, তাঁকেও চাঁদা দিতে হয়। কারখানা করার জন্য জমিতে বালু ভরাটের কাজ ইউপি চেয়ারম্যানের লোকজনকে দিতে হয়। তাঁর লোকজনকে কারখানায় চাকরি দিতে হয়। কিন্তু তাঁরা কাজ না করে সারাক্ষণ ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে থাকেন। তবে বেতন ঠিকই নেন। এ ছাড়া বিভিন্ন দিবসে অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা বলে চাঁদা তোলেন ইউপি চেয়ারম্যান।
ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, সরকার নির্ধারিত টাকার বাইরে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য অতিরিক্ত কোনো টাকা নেওয়া হয় না। তিনি বা তাঁর লোকজন কোনো কারখানা থেকে চাঁদা তোলেন না। অন্য অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন।
তবে মুঠোফোনে গোপনে ধারণ করা এক ভিডিওতে ট্রেড লাইসেন্সের জন্য একজনের কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাইতে শোনা যায়। আরও বলা হচ্ছিল, এখানে জমি কিনলে ও বেচলে কমিশন দিতে হয়। টাকা দাবি করা ব্যক্তি ইউপি চেয়ারম্যান বলে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর ভাষ্য।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চাঁদা না দিলে কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশদূষণের অভিযোগ তোলেন ইউপি চেয়ারম্যান ছাদাকাত। তিনি তাঁর লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে সেই কারখানার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন, নানা অপপ্রচার চালান।
অবশ্য ড্রেজার মেশিন দিয়ে সমুদ্র থেকে বালু উত্তোলন করে নিচু জমি ভরাট করায় গত মার্চ মাসে বাড়বকুণ্ড ইউপির চেয়ারম্যান ছাদাকাতসহ তিনজনকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাদাকাত প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এলাকায় বালু দিয়ে জমি ভরাট করার কাজ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।
চাঁদাবাজিসহ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে সীতাকুণ্ড মডেল থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিন আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখানে (থানা) নতুন এসেছি। আমি এখানে আসার পর এখন পর্যন্ত চাঁদাবাজির কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব।’